সমুদ্র বিপুল সম্পদের ভাণ্ডার। এছাড়া বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ২/৩ অংশ সমুদ্রপথে সম্পন্ন হয়। সমুদ্রের এরূপ গুরুত্ব বিবেচনায় সমুদ্রের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতে ১৯৮২ সালে আন্তর্জাতিক সমুদ্র কনভেনশন প্রনীত হয়েছে।
বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে সর্বপ্রথম জাতীয় সংসদ কর্তৃক সমুদ্র আইন বা আঞ্চলিক পানি ও সামুদ্রিক এলাকা আইন-১৯৭৪ পাস করা হয়। পরবর্তীতে জাতিসংঘের “সমুদ্র আইন বিষয়ক জাতিসংঘ কনভেনশন, ১৯৮২” প্রণীত হয় যা আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন নামে পরিচিত। বর্তমানে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই এ চুক্তি মেনে চলে। তবে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, ইউক্রেন, পেরু, ভেনেজুয়েলাসহ বেশ কয়েকটি দেশ এখনও এ কনভেনশনে স্বাক্ষর করে নি।
নাম | United Nation Convention on Law of the Sea (UNCLOS) |
বিষয়বস্তু | আন্তর্জাতিক সমুদ্র বিষয়ক আইন |
স্বাক্ষর | ১৯৮২, মন্টিগো বে, জামাইকা |
কার্যকর | ১৯৯৪ |
বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে | ১০ ডিসেম্বর ১৯৮২ |
UNCLOS মূলত সামুদ্রিক অঞ্চলে বিভিন্ন দেশসমূহের অধিকার সম্পর্কিত একটি আন্তর্জাতিক আইন। এ আইনের বিষয়বস্তু নিম্নরূপ –

অভ্যন্তরীণ জলসীমা (Inland or Internal water)
আঞ্চলিক সমুদ্রের ভিত্তিরেখা থেকে স্থলভাগ পর্যন্ত যে জলরাশি তা উপকূলবর্তী রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ জলরাশি।
সমুদ্র তটরেখা বা ভিত্তি রেখা (Base line or Low water line)
উপকূলীয় যে রেখা হতে সমুদ্রের দিকে একটি রাষ্ট্রের সমুদ্র অঞ্চল মাপা হয় তাই ভিত্তি রেখা বা Low water line। সাধারণত ভাটার সময় উপকূলের নিম্নতম জলসীমাকে ভিত্তি রেখা ধরা হয়। বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালে সরকারীভাবে বিজ্ঞপ্তি প্রদান করে উপকূলীয় সমুদ্রের ১০ ফ্যাদম বা ৬০ ফুট গভীরতা পর্যন্ত ভিত্তিরেখা হিসাবে গ্রহণ করে।
আঞ্চলিক বা রাজনৈতিক সীমা (Territorial Sea)
তটরেখা থেকে সমুদ্রের দিকে ১২ নটিক্যাল মাইল। এ এলাকার উপর উপকূলবর্তী রাষ্ট্রের সার্বভৌম অধিকার বিদ্যমান থাকে। সমুদ্রের নিচের তেল, গ্যাসসহ অন্যান্য খনিজ সম্পদ, সামুদ্রিক মাছসহ অন্যান্য প্রাণী ইত্যাদি সকল সম্পদের উপর উপকূলীয় রাষ্ট্রের একচ্ছত্ব অধিকার থাকবে। আঞ্চলিক সমুদ্রের উপরের আকাশসীমা উপকূলী রাষ্ট্রের National Air Space এর মধ্যে পড়বে। ফলে অনুমতি ছাড়া অন্য কোন দেশের কোন বিমান এই সীমায় প্রবেশ করতে পারবেনা।
সংলগ্ন অঞ্চল (Contiguous Zone)
ভিত্তিরেখা থেকে ২৪ নটিক্যাল মাইল এলাকা। অর্থাৎ আঞ্চলিক জলসীমার পরবর্তী ১২ নটিক্যাল মাইল এলাকা। উপকূলীয় রাষ্ট্র তার সংলগ্ন অঞ্চলের সমুদ্রের মধ্যে তার কাস্টমস, আর্থিক, অভিবাসন আইন এবং প্রবিধানের লঙ্ঘন রোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করতে পারে এবং উক্ত অঞ্চলে আইন এবং বিধি লঙ্ঘনের জন্য শাস্তি দিতে পারে। সংলগ্ন অঞ্চলের সমুদ্রে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তু উপকূলীয় রাষ্ট্রের সম্মতি ব্যতীত সমুদ্রতল থেকে অপসারণ বেআইনি।
একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল (Exclusive Economic Zone)
ভিত্তিরেখা থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত উপকূলীয় রাষ্ট্রের একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল। অর্থাৎ আঞ্চলিক জলসীমার পরে এর দৈর্ঘ্য ১৮৮ নটিক্যাল মাইল। এ অঞ্চলে উপকূলীয় রাষ্ট্রের কৃত্রিম দ্বীপ, স্থাপনা ও অবকাঠামো, সামুদ্রিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা, এবং সামুদ্রিক পরিবেশের সুরক্ষা ও সংরক্ষণের এখতিয়ার রয়েছে। এছাড়া প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান, শোষণ, সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা সর্বপরি অর্থনৈতিক শোষণ ও অন্বেষণের জন্য অন্যান্য ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে উপকূলীয় রাষ্ট্রের সার্বভৌম অধিকার রয়েছে।
মুক্ত সাগর (High Sea)
ভিত্তিরেখা থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইলের পরবর্তী বিস্তীর্ণ জলভাগ। সকল রাষ্ট্রের জন্য এ অঞ্চল উন্মুক্ত। এমনকি ভূবেষ্টিত রাষ্ট্রেও এ অঞ্চলে অন্য রাষ্ট্রের সমান অধিকার ভোগ করবে।
মহীসোপান (Continental Shelf)
উপকূলবর্তী রাষ্ট্রের উপকূল থেকে অগভীর সমুদ্রাঞ্চলকে মহীসোপান বলে। ২০০ নটিক্যাল মাইলের পরেও যদি অগভীর সমুদ্র থাকে তাহলে উপকূলীয় দেশ ৩৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপান হিসেবে ভোগ করে থাকে। ৩৫০ নটিক্যাল মাইলের পরেও অগভীর সমুদ্র থাকলে সেটিও উপকূল রাষ্ট্র ভোগকরবে। তবে এক্ষেত্রে শর্ত থাকে যে ২০০ নটিক্যাল মাইলের পরের অংশ থেকে প্রাপ্ত আয়ের একটি অংশ International Seabed Authority কে প্রদান করতে হবে। বাংলাদেশের মহীসোপান ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল।
বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা বিরোধ
সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের জেরে বাংলাদেশ ২০০৯ সালে জার্মানিতে অবস্থিত International Tribunal for Law of the Sea – এ ভারতের বিরুদ্ধে এবং নেদারল্যান্ডের হেগে অবস্থিত Permanent Court of Arbitration – এ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করে। ২০১২ সালে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলার রায়ে জিতে বাংলাদেশ প্রায় ১ লক্ষ বর্গ কি. মি. সমুদ্র এলাকা লাভ করে। অন্যদিকে ২০১৪ সালে ভারতের বিরুদ্ধে মামলার রায়ে জিতে বাংলাদেশ ১৯, ৪৬৭ বর্গ কি. মি. সমুদ্র এলাকা লাভ করে। সমুদ্রে বাংলাদেশের মোট আয়তন ১, ১৮, ৮১৩ বর্গ কি.মি.।