আলোক বিজ্ঞান

Estimated Reading Time: 45 Minutes

আলো

আলো এক ধরণের শক্তি যা চোখে প্রবেশ করে দর্শনের অনুভূতি জন্মায়। আলো কোন বস্তু থেকে উৎপন্ন হয়ে শক্তির ক্ষুদ্র প্যাকেট (ফোটন) বা গুচ্ছ আকারে সঞ্চালিত হয় এবং আমাদের চোখে পৌছে দর্শনের অনুভুতি জন্মায়। অবস্থাভেদে আলো কণা বা তরঙ্গের মত আচরণ করতে পারে; তবে একসঙ্গে কণা ও তরঙ্গ নয়।

আলোর বেগ

আলো যে বেগে চলে তাই আলোর। আলো চলাচলের জন্য মাধ্যম আবশ্যক নয় এবং শূন্য মাধ্যমে আলোর বেগ সর্বোচ্চ। শূন্য মাধ্যমে আলোর বেগ সেকেন্ডে ৩ লক্ষ মিটার (৩ ✕ ১০ মিটার প্রতি সেকেন্ডে)। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে মোট ৫০০ সেকেন্ড বা ৮ মিনিটি ২০ সেকেন্ড (৮.৩২ মিনিট)। উল্লেখ্য সব তড়িৎ চৌম্বক তরঙ্গের (যেমন: তাপ, বেতার তরঙ্গ, এক্সরে, অতিবেগুনী রশ্মী ইত্যাদি) বেগই শূন্য মাধ্যমে আলোর বেগের সমান। আলো যখন শূন্য মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে প্রবেশ করে তখন আলোর গতি কমে যায়। ঘন মাধ্যম প্রবেশের সময় আলোর বেগ বেশী কমে যায় এবং হালকা মাধ্যমে প্রবেশের সময় আলোর বেগ খুব অল্প পরিমাণে কমে যায়।

আলোকবর্ষ: এক বছরে আলো যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে এক আলোকবর্ষ বলে। ১ আলোকবর্ষ সমান ৯৪,৬০০ কোটি কিলোমিটার (৯.৪৬ ✕ ১০ কিলোমিটার)।

সূর্য ধ্বংস হওয়ার কিছুক্ষণ পরও সূর্যকে দেখা যাবে

সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড লাগে। তাই সূর্য ধ্বংস হওয়ার পূর্বে সূর্য থেকে নির্গত সর্বশেষ আলোক রশ্মি আমাদের চোখে আসতে ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড লাগবে। তাই সূর্য ধ্বংস হওয়ার পর ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড পর্যন্ত আমরা সূর্য দেখতে পাব। অনুরূপ কারণে রাতের আকাশে আমরা বর্তমানে যেসব নক্ষত্র দেখি তাদের অনেকেই হয়ত অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে!

আলোক তত্ত্ব

কণাতত্ত্ব: ১৬৭২ সালে স্যার আইজ্যাক নিউটন প্রদত্ত এ তত্ত্ব অনুসারে – কোন উজ্জ্বল বস্তু থেকে অনবরত ঝাঁকে ঝাঁকে অতি ক্ষুদ্র কণা নির্গত হয়। এ কণাগুলো প্রচণ্ড বেগে সরলরেখা বরাবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং যখন আমাদের চোখে গিয়ে আঘাত করে তখন ঐ বস্তু সম্পর্কে আমাদের দর্শানুভূতি হয়। কণাগুলোর আকারের ভিন্নতার জন্য বিভিন্ন বর্ণের সৃষ্টি হয়। এই তত্ত্বের সাহায্যে আলোর ঋজুগতি, প্রতিফলন, প্রতিসরণ ইত্যাদি আলোকীয় ঘটনা ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু ব্যাতিচার, সমবর্তন, বিচ্ছুরণ ইত্যাদি ঘটনার কোন ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় না।

তরঙ্গতত্ত্ব: ১৬৭৮ সালে হাইগেন প্রদত্ত এ তত্ত্ব অনুসারে আলো ইথার নামে এক কাল্পনিক মাধ্যমের ভিতর দিয়ে তরঙ্গ আকারে আলোর বেগে সঞ্চালিত হয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায় এবং আমাদের চোখে পৌঁছে দর্শনের অনুভূতি সৃষ্টি করে। ইথারকে কল্পনা করা হয় একটি নিরবচ্ছিন্ন মাধ্যম রূপে যার স্থিতিস্থাপকতা অনেক বেশি কিন্তু ঘনত্ব খুবই কম। আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য খুব কম এবং নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ নির্দিষ্ট বর্ণের অনুভূতি সৃষ্টি। এই তত্ত্বের সাহায্যে প্রতিফলন, প্রতিসরণ, বিচ্ছুরণ, ব্যাতিচার ও অপবর্তন ব্যাখ্যা করা গেলেও সমবর্তন, আলোক তড়িৎক্রিয়া ব্যাখ্যা করা যায়নি। এছাড়া মাইকেলসন, মর্লি প্রমাণ করেন ইথার বলে কিছু নেই। এছাড়া ফটোতড়িৎক্রিয়া এই তত্ত্বের সাহায্যে ব্যাখ্যা দেয়া যায় না।

তড়িৎ চৌম্বক তত্ত্ব: ১৮৬৪ সালে ম্যাক্সওয়েল প্রদত্ত এ তত্ত্ব অনুসারে যখন গতিশীল চৌম্বক ও তড়িৎ ক্ষেত্রের দ্রুত পর্যাবৃত্ত পরিবর্তন ঘটে তখন দৃশ্য ও অদৃশ্য বিকিরণের উদ্ভব হয় যা তরঙ্গ আকারে আলোর বেগে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাড়িত চৌম্বক তরঙ্গ একটি অনুপ্রস্থ তরঙ্গ।

কোয়ান্টাম তত্ত্ব: ১৯০০ সালে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক প্রদত্ত এ তত্ত্ব অনুসারে “আলোকশক্তি কোন উৎস থেকে অবিচ্ছিন্ন তরঙ্গের আকারে না বেরিয়ে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তিগুচ্ছ বা প্যাকেজ আকারে বের হয়।” প্রত্যেক রঙের আলোর জন্য এ শক্তি প্যাকেটের শক্তির একটা সর্বনিম্ন মান থাকে। এই সর্বনিম্নমানের শক্তিসম্পন্ন কণিকাকে কোয়ান্টাম বা ফোটন বলে। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন এই তত্ত্বের প্রমাণ করেন। এজন্য তিনি ১৯১১ সালে নোবেল পুরস্কার পান।

আলো কখনও তরঙ্গের মত আচরণ করে, আবার অন্য সময় তার আচরণ কণাধর্মী। ফটো তড়িৎ ক্রিয়ার মতো ঘটনা আলোর কণারূপকে উৎঘাটন করে। আবার ব্যাতিচার, সমবর্তন, অপবর্তন ইত্যাদি ঘটনা আলোর তরঙ্গ ধর্মকে প্রকাশ করে। ম্যাক্সবর্নের ব্যবস্থা অনুসারে এখন মনে করা হয় অবস্থা বিশেষ আলোক কণা অথবা তরঙ্গরূপে আচরণ করে। তবে কখনোই এক সঙ্গে কণা এবং তরঙ্গ নয়।

আলোর বৈশিষ্ট্য বা ধর্মাবলী

  • আলো সরলরেখায় চলে।
  • আলোর প্রতিফলন, প্রতিসরণ, ব্যতিচার, অপবর্তন, সমবর্তন, বিচ্ছুরন ঘটে।
  • শূন্য মাধ্যমে আলোর গতি সর্বোচ্চ।
  • আলো কখনও তরঙ্গ এবং কখনও কণার ন্যায় আচরণ করে।
  • আলো এক প্রকার শক্তি।

আলোর প্রতিসরণ

প্রতিসরন অর্থ ভেদ করে যাওয়া বা পার হয়ে যাওয়া । আলো কোন স্বচ্ছ মাধ্যমের পড়লে কিছু আলো মাধ্যম ভেদ করে চলে যায়। আলোর চলে যাওয়ার এই ঘটনাকে আলোর প্রতিসরন বলে ।
আলোর প্রতিসরনের কারনে পানিতে দাড়ালে পা খাটো দেখা যায়, পানিতে নৌকার বৈঠা বাকা দেখা যায়, গ্লাসের পানিতে পয়সা রাখলে কিছুটা উপরে দেখা যায় ।

উল্লেখ্য আলো যখন এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে যায় তখন সেখানে তিনটি ঘটনা ঘটে যা হল প্রতিফলন, প্রতিসরন, বিশোষন। আলোর বিশোষন হল মাধ্যম কর্তৃক কিছু আলো শোষিত হয় ।

সংকট কোণ বা ক্রান্তি কোণ কাকে বলে?

নিদিষ্ট বর্ণের কোন আলোক রশ্মি ঘন মাধ্যম হতে হালকা মাধ্যমে যাওয়ার সময় যে আপতন কোণের জন্য প্রতিসরন কোণ ৯০° হয় সেই আপতন কোণকে সংকট বা ক্রান্তি কোণ বলে। সংকট কোণ আলোর বর্ণের উপর নির্ভর করে।

উদাহরণ: পানির সাপেক্ষে হীরকের ক্রান্তি কোণ ৩৩° বলতে বোঝায় হীরক থেকে আলো পানিতে প্রতিসরিত হওয়ার সময় আপতন কোণ ৩৩° হলে পানি বিভেদতল ঘেষে যাবে অর্থাৎ প্রতিসরণ কোণ ৯০° হবে।

রংধনু সবসময় সূর্যের বিপরীত দিকে গঠিত হয় কেন?

সূর্যের আলো বৃষ্টির ফোটার ওপর পড়লে বৃষ্টির ফোটা প্রিজমের ন্যায় কাজ করে এবং সূর্যের আলোকে সাত বর্ণে বিশ্লিষ্ট করে। ফলে সূর্যের বিপরীত দিকে আকাশে উজ্জ্বল বর্ণের অর্ধ্ববৃত্ত তৈরি হয় যা রংধনু নামে পরিচিত। রংধনু গঠনে যেহেতু সূর্য আলোক উৎস এবং বৃষ্টির ফোটা প্রিজমের সূর্যের বিপরীত দিকের আকাশ পর্দা হিসেবে কাজ করে ফলে রংধনু সবসময় সূর্যের বিপরীত দিকে গঠিত হয়।

হীরক উজ্জল দেখায় কেন?

বায়ু সাপেক্ষে হীরকের সংকট কোণ ২৪.৪°। তাই হীরকে আলোকরশ্মি সামান্য কোণে আপতিত হলে আপতন কোণ সংকট কোণ অপেক্ষা বড় হয়ে যায়। ফলে আলোক রশ্মির পূর্ণ অভ্যান্তরীণ প্রতিফলন হয়। ফলে বেশী পরিমাণ আলোকরশ্মি চোখে পড়ে এবং হীরক উজ্জ্বল দেখায়। উল্লেখ্য কাচের সংকট কোণ ৪২° অপেক্ষা হীরকের সংকট কোণ ২৪° কম হওয়ায় কাচ অপেক্ষা হীরক উজ্জ্বল দেখায়।

আলোর প্রতিফলন

আলো কোন মাধ্যমের উপর পড়লে আলোর কিছু অংশ ঐ মাধ্যম কর্তৃক বাধা পেয়ে প্রথম মাধ্যমে ফিরে আসে। আলোর এই ফিরে আসার ধর্মকে আলোর প্রতিফলন বলে। যেমন: আয়নায় আলোর প্রতিফলনের ফলে আমরা আমাদের প্রতিবিম্ব দেখতে পাই। মসৃণ তলে আলোর প্রতিফলন বেশী (নিয়মিত) এবং অমসৃন তলে আলো তুলনামূলক কম (অনিয়মিত) প্রতিফলিত হয়। পেরিস্কোপ তৈরিতে আলোর প্রতিফলন ব্যবহার করা হয়। সমুদ্রের নিচে সাবমেরিন হতে সমুদ্রের উপরে দেখার জন্য, ভিড়ের মধ্যে খেলা দেখার জন্য পেরিস্কোপ ব্যবহার করা হয়।

দর্পণ: দর্পণ বা আয়নাতে আলোর নিয়মিত প্রতিফলন হয়। দর্পণ সমতল বা গোলীয় আকৃতির হতে পারে। সাধারণত আয়নায় চেহারা দেখার জন্য সমতল দর্পণ ব্যবহৃত হয়। সমতল দর্পণে নিজের পূর্ণ চেহারা দেখার জন্য দর্পণের দৈর্ঘ্য দর্শকের উচ্চতার অন্তত অর্ধেক হতে হয়। এছাড়া পেরিস্কোপে সমতল দর্পণ ব্যবহৃত হয়।

গোলাকৃতির দর্পন প্রধানত দুই প্রকার। যথা

  • উত্তল দর্পণ: যদি কোন গোলকের উত্তল পৃষ্ঠ প্রতিফলকের ন্যায় আচরণ করে তবে তাকে উত্তল দর্পণ বলে। এতে খর্বিত প্রতিবিম্ব পাওয়া যায়। ফলে এধরণের দর্পণে বড় বস্তুর ছোট প্রতিবিম্ব দেখা যায়। গাড়ির ভিউ মিররে উত্তল দর্পণ ব্যবহৃত হয়।
  • অবতল দর্পণ: যদি কোন গোলকের অবতল পৃষ্ঠ প্রতিফলকের ন্যায় আচরণ করে তবে তাকে অবতল দর্পণ বলে। এতে বিবর্ধিত প্রতিবিম্ব পাওয়া যায়। ফলে ছোট বস্তুর বড় প্রতিবিম্ব দর্শক দেখতে পান। সাধারণত দন্ত চিকিতসকগণ অবতল দর্পণ ব্যবহার করেন।

আলোর পূর্ণ অভ্যন্তরীন প্রতিফলন: আলোক রশ্মি ঘন মাধ্যম হতে হালকা মাধ্যমে যাওয়ার সময় যদি সংকট কোণের চেয়ে বেশী কোণে আপতিত হয় তাহলে আলোক রশ্মি প্রতিসরিত না হয়ে পুনরায় ঘন মাধ্যমে ফিরে আসে। একে পূর্ণ অভ্যন্তরীন প্রতিফলন বলে। পূর্ণ অভ্যন্তরীন প্রতিফলন এর শর্ত দুটি । যথা :

  • আলোক রশ্মি ঘন মাধ্যম হতে হালকা মাধ্যমের বিভেদতলে আপতিত হবে
  • আপতন কোণ সংকট কোণের চেয়ে বড় হবে

উত্তপ্ত মরু অঞ্চলে দৃষ্টিভ্রম, প্রখর রোদে উত্তপ্ত পিচঢালা মসৃণ রাজপথ ভেজা ও চকচকে মনে হয় আলোর পূর্ণ অভ্যন্তরীন প্রতিফলনের কারণে। এদের মরিচীকা বলে।

উত্তপ্ত মরুভুমিতে মরিচীকা সৃষ্টি হয় কেন?

আলোর পূর্ণ অভ্যন্তরীন প্রতিফলনের দরুন উত্তপ্ত মেরু অঞ্চলে বা শীতপ্রধান মেরু অঞ্চলে এক ধরনের দৃষ্টিভ্রম ঘটে যা মরিচীকা নামে পরিচিত । মরুভুমিতে সূর্যের প্রচণ্ড তাপে ভূমি সংলগ্ন বায়ু খুব তাড়াতাড়ি উত্তপ্ত হয়। তাপমাত্রা বেশী হওয়ায় বালি সংলগ্ন বায়ু হালকা হয়।ফলে ভূপৃষ্ট হতে যত উপরে যাওয়া যায় বায়ুর ঘনত্ব তত বাডতে থাকে। ফলে দুরে কোন গাছ থেকে যখন আলোক রশ্মি পথিকের চোখে এসে পড়ে তখন তা ঘনতর মাধ্যম হতে হালকা মাধ্যমে প্রবেশ করে। ফলে প্রতিসরিত রশ্মি অভিলম্ব থেকে দুরে সরে যায়। এভাবে দুরে দুরে সরতে সরতে এক সময় আপতন কোণ সংকট কোণ এর চেয়ে বড় হয়। এসময় আলোক রশ্মির পূর্ণ অভ্যান্তরীণ প্রতিফলন হয় এবং আলোক রশ্মি উপরে উঠে বাঁকা পথে পথিকের চোখে পৌছে যা পিছন দিকে বাডালে ঐ অবস্থানে গাছটির উল্টো প্রতিবিম্ব দেখাবে। কিন্তু পথিকের চোখে আলোর এ ঘটনা ধরা পডেনা বরং তার কাছে মনে হয় কাছে কোথাও জলাশয় আছে এবং তা থেকে প্রতিফলিত হচ্ছে। পথিকের কাছে এ দুরত্ব সবসময় সমান মনে হয়। একে মরিচীকা বলে।

আলোর ব্যতিচার

দুই বা ততোধিক আলোক তরঙ্গ পরস্পর উপরিপাতনের ফলে মাধ্যমের মধ্যে কোথাও আলোকতীব্রতা বৃদ্ধি পেয়ে উজ্জ্বল বিন্দু আবার কোথাও আলোকতীব্রতা হ্রাস পেয়ে অন্ধকার বিন্দু সৃষ্টি হয়। ফলে পর্যায়ক্রমে আলোকজ্জ্বল ও অন্ধকার অবস্থার সৃষ্টি হয়। একে আলোর ব্যতিচার বলে। অর্থ্যাৎ আলোক তরঙ্গের উপরিপাতনের ফলে আলোর তীব্রতার পর্যায়ক্রমিক তারতম্যই আলোর ব্যতিচার। এক্ষেত্রে আলোক তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে তাকে গঠনমূলক ব্যতিচার এবং আলোক তীব্রতা হৃাস পেলে তাকে ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার বলে।

আলোর বিক্ষেপণ

আলো যখন এক মাধ্যম থেকে অপর মাধ্যমে যায় তখন আলোর একটি অংশ ঐ মাধ্যমের অণুগুলোর দ্বারা শোষিত হয় এবং এই শোষিত আলোকরশ্মির আবার বিভিন্ন দিকে বিকিরণ ঘটে। এই ঘটনাকে বিক্ষেপণ বলে। এক বর্ণের বস্তু ঐ বর্ণের আলো ছাড়া অন্যান্য বর্ণের আলোকে শোষণ করে। ফলে এক বর্ণের বস্তু অন্য বর্ণের মাঝে কালো দেখায়। যেমন: লাল বর্ণের বস্তু লাল ব্যতীত অন্য যে কোন আলোকে শোষণ করবে। ফলে লাল বর্ণের মাঝে অন্য যে কোন বর্ণের বস্তু কালো দেখাবে। কোন বস্তু যখন সকল আলো প্রতিফলন করে তখন সেটি সাদা দেখায় (যেহেতু সাদা আলো সাত বর্ণের সমন্বয়ে গঠিত) আর যখন সকল আলো শোষণ করে তখন সেটি কালো দেখায়।

আলোর বিক্ষেপণ তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ওপর নির্ভর করে। তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত ছোট হবে, মাধ্যমের গ্যাসীয় অণুগুলোর সাথে তরঙ্গের সংঘর্ষের পরিমাণ তত বেশি হবে। অপরদিকে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়লে এই সংঘর্ষের পরিমাণ কম হবে। তাই তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়লে বিক্ষিপ্ত আলোর তীব্রতা কমবে এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমলে বিক্ষিপ্ত আলোর তীব্রতা বাড়বে। সুতরাং যে বর্ণের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম, সেই আলাে বেশি বিক্ষিপ্ত হয়। অর্থাৎ, লাল আলোর বিক্ষেপণ সবথেকে কম এবং নীল আলোর বিক্ষেপণ সবথেকে বেশি হবে।

আকাশের রং নীল কেন?

সূর্যের সাদা আলো মূলত সাতটি রংয়ের সমন্বয়ে গঠিত একটি যৌগিক আলো। এর মধ্যে লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশী হওযায় এর বিক্ষেপন কম। আবার বেগুনী আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কম কিন্তু বিক্ষেপণ সবচেয়ে বেশী। ফলে যখন সূর্যের রশ্মি বায়ুমণ্ডলের সুক্ষ্ম ধুলিকণা ও বিভিন্ন গ্যাস অনুতে বিশ্লিষ্ট হয় তখন বেগুনি, নীল ও আসমানি আলোর বিক্ষেপণ বেশী হয়। যেহেতু নীল আলোর বিক্ষেপণ মাঝামাঝি হিসেবে বিক্ষেপিত হয় ফলে আকাশে নীল আলোর প্রাচুর্য থাকে বেশী। ফলে আকাশ নীল দেখায়।

সূর্যদয় ও সূর্যাস্তের সময় সূর্য লাল দেখা যায় কেন?

সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় সূর্য দিগন্তরেখার কাছাকাছি থাকে। ফলে সূর্যরশ্মিকে পুরু বায়ুস্তর ভেদ করে আমাদের চোখে আসতে হয়। এসময় বেগুণী, নীল ও আসমানি আলোর বিক্ষেপণ বেশী হওয়ায় তা আমাদের চোখে পৌছে না। কিন্তু লাল আলোর বিক্ষেপণ কম হওয়ায় তা বায়ুস্তর ভেদ করে আমাদের চোখে পৌছায়। ফলে সূর্যদয় ও সূর্যাস্তের সময় সূর্য লাল দেখায়।

চাঁদের আলোতে গাছের সবুজ পাতা কেমন দেখায়?

গাছের পাতা রং সবুজ। তাই পাতা সবুজ বর্ণ বাদ দিয়ে অন্য যে কোন বর্ণকে শোষন করবে। চাদের আলো সাধারনত হলুদ হয়। ফলে চাঁদের হলুদ আলো গাছের পাতায় পড়লে সবুজ পাতা চাঁদের হলুদ আলোকে শোষন করে ফেলে। ফলে কোন আলো প্রতিফলিত হয় না। তাই চাদের হলুদ আলোতে গাছের পাতা কালো দেখায় ।

আলোর বিচ্ছুরণ

সাদা আলো যৌগিক। এ আলো যদি প্রিজমে আপতিত হয় তাহলে প্রিজমের মধ্য দিয়ে যাবার সময় সাতটি বর্ণে বিশ্লিষ্ট হয়। যৌগিক সাদা আলোর বিশ্লিষ্ট হওয়ার এ ধর্মই আলোর বিচ্ছুরন। বিচ্ছুরনের ফলে আলো যে সাতটি বর্ণে বিশ্লিষ্ট হয় তাকে আলোর বর্ণালি বলে। আলোর সাতটি বর্ণ হল বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল (সংক্ষেপে বেনীআসহকলা)।

উদাহরণ: সূর্যের আলো প্রিজমের মধ্য দিয়ে যাবার সময় সাতটি বর্ণে বিশ্লিষ্ট হয়। রংধনু সৃষ্টির সময় বৃষ্টির ফোটা প্রিজমের কাজ করে । রংধনু সাধারনত সকালে পশ্চিম ও বিকালে পূর্ব আকাশে দেখা যায়।

তড়িত চুম্বক বর্ণালী

আলোক তরঙ্গ ‘তড়িৎ চুম্বক বর্নালি’র একটি বিস্তৃত সীমার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অংশবিশেষ। তড়িৎ চুম্বক বর্ণালীতে থাকে দৃশ্যমান আলো অবহেলিত বেতার তরঙ্গ অতিবেগুনি রশ্মি এক্স রশ্মি ও গামা রশ্মি। তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম হলে আলোর ভেদনক্ষমতাও কম হয় যা মানব শরীরের জন্য কম ক্ষতিকর হয়।

তড়িৎচৌম্বক বর্ণালীতরঙ্গদৈর্ঘ্যের গড় বিস্তারতথ্য
গামা রশ্মি< ১ ন্যানোমিটারসবচেয়ে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘের রশ্মি। পারমাণবিক বিস্ফোরণের সময় নির্গত রেডিয়েশনের অধিকাংশই গামা রশ্মি। এ রশ্মির প্রভাবে দেহ পুড়ে যেতে পারে, ক্যান্সার, টিউমার প্রভৃতি হতে পারে।
রঞ্জন রশ্মি (X-ray)১ – ১০ ন্যানোমিটাররোগ নির্নয় বিশেষ করে হাড়ের ফাটল ও টিউমারের উপস্থিতি নির্নয়ে ব্যবহৃত হয়।
অতিবেগুনী রশ্মি১০ – ৪০০ ন্যানোমিটারত্বকে ভিটামিন ডি তৈরিতে সাহায্য করে। তবে বেশিক্ষণ এ রশ্মিতে থাকলে ক্ষতি হতে পারে।
দৃশ্যমান আলো তরঙ্গ৪০০ – ৭০০ ন্যানোমিটারদৃশ্যমান আলোর মধ্যে আবার বিভিন্ন রঙের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিভিন্ন। এদের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ক্রম – বেগুনি < নীল < আসমানি < সবুজ < হলুদ < কালো < লাল (বেনিআসহকলা)
অবলোহিত রশ্মি৭০০ ন্যানোমিটার – ১ মিলিমিটারসূর্য থেকে যে বিকীর্ণ তাপ আসে তাকে অবলোহিত রশ্মি বলে। এছাড়া কাঠের আগুন বা বৈদ্যুতিক চুলা থেকে অবলোহিত রশ্মির তাপ তরঙ্গ নির্গত হয়।
অণুতরঙ্গ (মাইক্রোওয়েভ)১ মিলিমিটার – ১০ সেন্টিমিটারটেলিভিশনের জন্য ব্যবহৃত মাইক্রোওয়ভের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৩ সে.মি.।
বেতার তরঙ্গ১০ সেন্টিমিটার – ৫০০০০ মিটারসর্ববৃহত তরঙ্গদৈর্ঘের রশ্মি।

আরও তথ্য –

উর্ধ্বাকাশে বিমান বা পাখির ছায়া মাটিতে পড়ে না কেন?

পাখি বা বিমান যখন উর্ধ্বাকাশে চলে তখন সূর্য আলোক উৎস, পাখি বা বিমান আলোক প্রতিবন্ধক, এবং মাটি পর্দা হিসেবে কাজ করে। আলোক উৎসের চেয়ে প্রতিবন্ধক অতান্ত ক্ষুদ্র হওয়ায় প্রচ্ছায়া হতে উপচ্ছায়া বড় হয়। আলোক উৎস হতে প্রতিবন্ধক ও পর্দার দুরত্ব অনেক বেশী হওয়ায় প্রচ্ছায়া মাটিতে পৌছে না। ফলে উর্ধ্বাকাশে বিমান বা পাখির ছায়া মাটিতে পড়ে না।

Leave a Reply