উপসর্গ

Estimated Reading Time: 15 Minutes

বাংলা ভাষায় কতগুলো অব্যয়সূচক শব্দাংশ রয়েছে যার নিজস্ব কোন অর্থ নেই, তবে এগুলো অন্য শব্দের সাথে যুক্ত হয়ে বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে থাকে। শব্দাংশগুলো মূল শব্দ বা ধাতুর পূর্বে যুক্ত হয়ে নতুন অর্থের সৃষ্টি করে। এসব অব্যয়সূচক শব্দাংশকে উপসর্গ বলে। ‘উপসর্গ’ কথাটির মূল অর্থ ‘উপসৃষ্ট’। এর কাজ হলো নতুন নতুন শব্দ গঠন করা। উপসর্গের অর্থবাচকতা নেই, কিন্তু অর্থ দ্যোতকতা আছে। অর্থ্যাৎ উপসর্গগুলোর কোনো অর্থবাচকতা নেই, শুধু মূল শব্দ বা ধাতুর পূর্বে এরা ব্যবহৃত হলেই এদের অর্থ দ্যোতকতা শক্তি দৃষ্ট হয়।

যেমনঃ ‘তাপ‘ একটি তৎসম শব্দ যার অর্থ উষ্ণতা বা উত্তাপ। এর পূর্বে ‘প্র’ উপসর্গ যুক্ত হয়ে ‘প্রতাপ‘ শব্দ গঠন করে যার অর্থ পরাক্রান্ত বা বীরত্ব। অনুরূপভাবে ‘অনা’ একটি উপসর্গ যার নিজের কোনো অর্থ নেই। কিন্তু ‘আবাদ’ শব্দের পূর্বে ‘অনা’ শব্দাংটি যুক্ত হয়ে ‘অনাবাদ’ তথা ‘আবাদ নেই যার’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার ‘সৃষ্টি’-র পূর্বে যুক্ত হয়ে ‘অনাসৃষ্টি’ (অদ্ভুত অর্থে) শব্দ তৈরি করেছে। সুতরাং উপসর্গের নিজস্ব কোনো অর্থ না থাকলেও এটি অন্য শব্দের পূর্বে যুক্ত হয়ে অর্থদ্যোতকতা বা সংশ্লিষ্ট শব্দের নতুন অর্থ সৃষ্টি করে থাকে।

প্রকারভেদ

বাংলা ভাষায় তিন প্রকার উপসর্গ রয়েছে। যথা: বাংলা উপসর্গ, সংস্কৃত উপসর্গ, বিদেশী উপসর্গ

বাংলা উপসর্গ

খাটি বাংলা বা দেশি উপসর্গ ২১টি। যথা-

উপসর্গঅর্থউদাহরণ
নিন্দিতকেজ, চেনা, অপয়া
অভাবঅচিন, অজানা, অথৈ
ক্রমাগতঅঝোর
অঘাবোকাঅঘারাম, অঘাচণ্ডী
অজনিতান্ত (মন্দ/প্রত্যন্ত)অজমূর্খ, অজপাড়াগাঁ, অজপুকুর
অনাঅভাবঅনাবৃষ্টি, অনাদর
ছাড়াঅনাচার, অনাসৃষ্টি
অশুভঅনামুখো
অভাবআকঁড়া, আধোয়া, আলুনি
বাজে/নিকৃষ্টআগাছা, আকাঠা
আড়বক্রআড়চোখে, আড়নয়নে
আধা/প্রায়আড়মোড়া, আড়পাগলা, আড়ক্ষ্যাপা
বিশিষ্ঠআড়কোলা, আড়গড়া, আড়কাঠি
আননাআনকোরা
আধা/বিক্ষিপ্তআনমনা, আনচান
আবঅস্পষ্টতাআবছায়া
ইতিএ বা এরইতিকর্তব্য, ইতিপূর্বে
পুরনোইতিকথা, ইতিহাস
ঊনকমঊনপাঁজুরে, উনিশ (উন+বিশ), ঊনাভাত
কদনিন্দিতকদবেল, কদর্য, কদাকার
কুকুৎসিত, অপকর্ষকুঅভ্যাস, কুকথা, কুনজর, কুসঙ্গ
নিনাই, নেতিনিখুঁত, নিখোঁজ, নিলাজ, নিভাঁজ, নিরেট, নিনাইয়া
পাতিক্ষুদ্রপাতিহাঁস, পাতিশিয়াল, পাতিলেবু, পাতকুয়ো
বিভিন্নতা, নাই বা নিন্দনীয়বিভূঁই, বিফল, বিপথ
ভরপূর্ণতাভরপেট, ভরসাঁঝ, ভরপুর, ভরদুপুর, ভরসন্ধ্যে
রামবড় বা উৎকৃষ্টরামছাগল, রামদা, রামশিঙ্গা, রামবোকা
সঙ্গেসরাজ, সরব, সঠিক, সজোর, সপাট
সাউৎকৃষ্টসাজিরা, সাজোয়ান
সুউত্তমসুনজর, সুখবর, সুদিন, সুনাম, সুকাজ
হাঅভাবহাপিত্যেশ, হাভাতে, হাঘরে

সংস্কৃত উপসর্গ

সংস্কৃত উপসর্গ ২০টি। যথা-

উপসর্গঅর্থদ্যোতকতাউদাহরণ
প্রপ্রকৃষ্ট/ সম্যকপ্রভাব, প্রচলন, প্রস্ফুটিত
খ্যাতিপ্রসিদ্ধ, প্রতাপ, প্রভাব
আধিক্যপ্রগাঢ়, প্রচার, প্রবল, প্রসার
গতিপ্রবেশ, প্রস্থান
ধারা-পরম্পরা বা অনুগামিতপ্রপৌত্র, প্রশাখা, প্রশিষ্য
পরাআতিশয্যপরাকাষ্ঠা, পরাক্রান্ত, পরায়ণ
বিপরীতপরাজয়, পরাভব
অপবিপরীতঅপমান, অপকার, অপচয়, অপবাদ
নিকৃষ্টঅপসংস্কৃতি, অপকর্ম, অপসৃষ্টি, অপযশ, অপব্যয়
স্থানান্তরঅপসারণ, অপহরণ, অপনোদন
বিকৃতিঅপমৃত্যু
সম্সম্যক রূপেসম্পূর্ণ, সমৃদ্ধ, সমাদর
সম্মুখেসমাগত, সম্মুখ
নিনিষেধনিবৃত্তি
নিশ্চয়নিবারণ, নির্ণয়
আতিশয্যনিদাঘ, নিদারুণ, নিগূঢ়
অভাবনিষ্কলুষ, নিষ্কাম
অবহীনতা, প্রতিকূলঅবজ্ঞা, অবমাননা
সম্যকভাবেঅবরোধ, অবগাহন, অবগত
নিম্নে, অধোমুখিতাঅবতরণ, অবরোহণ, অবলম্বন
অল্পতাঅবশেষে, অবসান, অবেলা
অনুপশ্চাৎঅনুশোচনা, অনুগামী, অনুজ, অনুচর, অনুতাপ, অনুকরণ
সাদৃশ্যঅনুবাদ, অনুরূপ, অনুকার
পৌনঃপুনঅনুক্ষণ, অনুদিন, অনুশীলন
সঙ্গেঅনুকূল, অনুকম্পা
নিরঅভাবনিরক্ষর, নিরব, নির্জীব, নিরহঙ্কার, নিরাশ্রয়, নির্ধন
নিশ্চয়নির্ধারণ, নির্ণয়, নির্ভর
বাহির, বহির্মুখিতানির্গত, নিঃসরণ, নির্বাসন
দুরমন্দদুর্ভাগ্য, দুর্দশা, দুর্নাম
কষ্টসাধ্যদুর্লভ, দুর্গম, দুরতিক্রম্য, দুর্মূল্য
বিবিশেষ রূপেবিধৃত, বিশুদ্ধ, বিজ্ঞান, বিবস্ত্র, বিশুষ্ক
অভাববিনিদ্র, বিবর্ণ, বিশৃঙ্খল, বিফল
গতিবিচরণ, বিক্ষেপ
অপ্রকৃতস্থবিকার, বিপর্যয়
সুউত্তমসুকণ্ঠ, সুকৃতি, সুচরিত্র, সুপ্রিয়, সুনীল
সহজসুগম, সুসাধ্য, সুলভ
আতিশয্যসুচতুর, সুকঠিন, সুধীর, সুনিপুণ, সুতীক্ষ্ণ
উৎঊর্ধ্বমুখিতাউদ্যম, উন্নতি, উৎক্ষিপ্ত, উদগ্রীব, উত্তোলন
আতিশয্যউচ্ছেদ, উত্তপ্ত, উৎফুল্ল, উৎসুক, উৎপীড়ন
প্রস্তুতিউৎপাদন, উচ্চারণ
অপকর্ষউৎকোচ, উচ্ছৃঙ্খল, উৎকট
অধিআধিপত্যঅধিকার, অধিপতি, অধিবাসী
উপরিঅধিরোহণ, অধিষ্ঠান
ব্যাপ্তিঅধিকার, অধিবাস, অধিগত
পরিবিশেষ রূপেপরিপক্ব, পরিপূর্ণ, পরিবর্তন
শেষপরিশেষ, পরিসীমা
সম্যক রূপেপরিশ্রান্ত, পরীক্ষা, পরিমাণ
চতুর্দিকপরিভ্রমণ, পরিমণ্ডল, পরিক্রমণ
প্রতিসদৃশপ্রতিমূর্তি, প্রতিধ্বনি
বিরোধপ্রতিবাদ, প্রতিদ্বন্দ্বী
পৌনঃপুনপ্রতিদিন, প্রতিমাস
অনুরূপ কাজপ্রতিঘাত, প্রতিদান, প্রত্যুপকার
উপসামীপ্য অর্থেউপকূল, উপকণ্ঠ
সদৃশউপদ্বীপ, উপবন
ক্ষুদ্রউপগ্রহ, উপসাগর, উপনেতা
বিশেষউপনয়ন (পৈতা), উপভোগ
অভিসম্যকঅভিব্যক্তি, অভিজ্ঞ, অভিভূত
গমনঅভিযান, অভিসার
সম্মুখ বা দিকঅভিমুখ, অভিবাদন
অতিআতিশয্যঅতিকায়, অত্যাচার, অতিশয়
অতিক্রমঅতিমানব, অতিপ্রাকৃত
পর্যন্তআকণ্য, আমরণ, আসমুদ্র
ঈষৎআরক্ত, আভাস
বিপরীতআদান, আগমন
অপিযদিঅপিচ (যদিও) (প্রাচীন বাংলা), অপিনিহিতি

উল্লেখ্য আ, সু, বি, নি – এ চারটি উপসর্গ বাংলা ও তৎসম উভয় উপসর্গে পাওয়া যায়।

মনে রাখার কৌশল: অবশেষে অপিঅভিঅনুরূপ অপরের প্রতি সম অধিকার সু প্রসারে অতি উৎসাহ পরাভব মরণ দুর উপনিবেশ বিচরণে গেছে।

বিদেশী উপসর্গ

আরবি, ফারসি, ইংরেজি ও উর্দু- হিন্দি— এইসব ভাষার উপসর্গ বাংলা ভাষায় প্রচলিত রয়েছে। যথা-

ফারসি

উপসর্গঅর্থউদাহরণ
কার্কাজকারখানা, কারসাজি, কারচুপি, কারবার, কারদানি
দর্মধ্যস্থ, অধীনদরপত্তনী, দরপাট্টা, দরদালান, দরখাস্ত
নানানাচার, নারাজ, নামঞ্জুর, নাখোশ, নালায়েক
নিম্আধানিমরাজি, নিমখুন, নিমমোল্লা
ফিপ্রতিফি-রোজ, ফি-হপ্তা, ফি-বছর, ফি-সন, ফি-মাস
বদ্মন্দবদমেজাজ, বদরাগী, বদমাশ, বদহজম, বদনাম, বজ্জাত, বদহাল, বদবখ্ত
বেনাবেআদব, বেআক্কেল, বেকসুর, বেকায়দা, বেহায়া, বেনজির, বেগতিক, বেতার, বেকার, বেশরম, বেতমিজ
বর্বাইরে, মধ্যেবরখাস্ত, বরদাস্ত, বরখেলাপ, বরবাদ
ব্সহিতবমাল, বনাম, বকলম, বহাল
কম্স্বল্পকমজোর, কমবখ্ত, কমআক্কেল, কমপোখ্ত
দস্তনিজদস্তখত
সেতিনসেতার, সেপায়া

মনে রাখার উপায়: কারখানার নাফি বদমেজাজী, বেয়াদবসেপায়াকমজোর নাখোসরা ফি-রোজ তাকে হাল না রাখাতে দস্তখতসহ দরখাস্ত করে।

আরবি

উপসর্গঅর্থউদাহরণ
আম্সাধারণআমদরবার, আমমোক্তার
খাস্বিশেষখাসমহল, খাসখবর, খাসখবর, খাসদরবার, খাসদখল
লানালাজওয়াব, লাখেরাজ, লাওয়ারিশ, লাপাত্তা
গর্অভাবগরমিল, গরহাজির, গররাজি
বাজেবিবিধ অপ্রয়োজনীয়বাজে খরচ, বাজে কথা, বাজে জমা
খায়েরভালোখায়ের খাঁ (মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী; বাগধারায়: তোষামোদকারী)

মনে রাখার উপায়: খাসমহলে বাজে গরমিল থাকায় আমলা এখন খায়ের খাঁ।

ইংরেজী

উপসর্গইংরেজি বানানঅর্থউদাহরণ
ফুলFullপূর্ণফুল-হাতা, ফুল-শার্ট, ফুল-বাবু, ফুল-প্যান্ট, ফুল-মোজা
হাফHalfআধাহাফ-হাতা, হাফ-টিকেট, হাফ-স্কুল, হাফ-প্যান্ট, হাফ-নেতা
হেডHeadপ্রধানহেড-মাস্টার, হেড-অফিস, হেড-পণ্ডিত, হেড-মৌলভি
সাবSubঅধীনসাব-অফিস, সাব-জজ, সাব-ইন্সপেক্টর

হিন্দি-উর্দু উপসর্গ

উপসর্গঅর্থউদাহরণ
হরপ্রত্যেকহররোজ, হরমাহিনা, হরহামেশা, হরকিসিম

বিবিধ

  • অভাব অর্থ ব্যবহৃত উপসর্গগুলো- অ, আ, অনা, হা, নি, নির, বি
    • – অচিন, অজানা, অথৈ। যেমন: অথৈ – থৈ বা নাগাল পাওয়া যায় না, থৈয়ের অভাব বুঝায়।
    • আকঁড়া, আধোয়া, আলুনি। যেমন: আলুনি – লবণের অভাব বোঝায়।
    • অনা – অনাবৃষ্টি, অনাদর। অনাবৃষ্টি – বৃষ্টির অভাব বুঝায়, অনাদর – আদরের অভাব বুঝায়।
    • হা – হাপিত্যেশ, হাভাতে, হাঘরে
    • নি – নিষ্কলুষ, নিষ্কাম। নিষ্কলুষ – যে কলুষিত নয় (খারাপ গুনের অভাব বোঝায়), নিষ্কাম – কামনার অভাব বুঝায়।
    • নির – নিরক্ষর (অক্ষরজ্ঞানের অভাব বোঝায়), নিরব, নির্জীব, নিরহঙ্কার, নিরাশ্রয়, নির্ধন।
    • বি – বিনিদ্র (নিদ্রার অভাব বোঝায়),বিবর্ণ, বিশৃঙ্খল, বিফল।
  • না অর্থে ব্যবহৃত উপসর্গগুলো- না, আন, বে, লা
    • না – নাচার, নারাজ, নামঞ্জুর, নাখোশ, নালায়েক
    • আন – আনকোরা
    • বে – বেআদব, বেআক্কেল, বেকসুর, বেকায়দা
    • লা – লাখেরাজ, লাওয়ারিশ, লাপাত্তা

Reference: Wikipedia

বাংলা আর্কাইভ

Leave a Reply