কবি, গীতিকার
জন্ম: ১১ই জৈষ্ঠ ১৩০৬ (২৪শে মে, ১৮৯৯), বর্ধমান; মৃত্যু: ১২ই ভাদ্র ১৩৮৩ (২৯ শে আগস্ট ১৯৭৬);
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক। তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ ও আধুনিক বাংলা গানের ‘বুলবুল’ নামে খ্যাত। নজরুলের ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। তিনি দশ বছর বয়সে গ্রামের মক্তব থেকে নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বারো বছর বয়সে
গানের দলে যোগ দেন। ১৯১৪ সালে ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুল এবং ১৯১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের এক স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন। কিন্তু ১৯১৭ সালে দশম শ্রেণীর পড়া শেষ না করেই তিনি সেনাবাহিনীতে ৪৯ নং বাঙালি প্লাটুনে যোগ দেন। ১৯২০ সালে সেনাবাহিনী ছেড়ে কোলকাতায় চলে আসেন। নজরুল ১৯২৪ সালে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের ভ্রাতুষ্পুত্রী আসালতা সেনগুপ্তের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন; বিয়ের পর স্ত্রীর নাম রাখেন প্রমীলা। ১৯২৫ সালে মহত্মা গান্ধীর মাধ্যমে তিনি কংগ্রেসের রাজনীতিতে যোগদান করেন। ১৯৪২ সালে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে কাজী নজরুল দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন এবং ১৯৭৬ সালে ৭৭ বছর বয়সে ঢাকার পিজি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করে।অবদান
কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্যকর্ম এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অবিভক্ত বাংলায় পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ ও দেশি-বিদেশি শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। ব্রিটিশ বিরোধী হওয়ার কারণে তৎকালীন ইংরেজ সরকার তাঁর বেশ কয়েকটি গ্রন্থ ও পত্রিকা নিষিদ্ধ করে এবং তাঁকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। নজরুল আদালতে ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ লিখে এবং প্রায় চল্লিশ দিন একটানা অনশন করে ইংরেজ সরকারের জেল-জুলুমের প্রতিবাদ করেন। নজরুলের সমর্থনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করে শ্রদ্ধা জানান। কাজী নজরুল অসংখ্য কবিতা, নাটক, গল্প, উপন্যাস, গান, প্রবন্ধ প্রভৃতি রচনা করে বাংলা সাহিত্যেকে সমৃদ্ধ করেছেন। নজরুলসঙ্গীতকে বাংলা সঙ্গীতের অণুবিশ্ব বলা হয়। তিনি বাংলা সাহিত্যে মুক্তক ছন্দের প্রবর্তক। এছাড়া বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম ইসলামি গান ও গজল রচনা করেছেন।
প্রথম রচনা
- রচনা/গল্প: বাউণ্ডেলের আত্নকাহিনি (১৯১৯)। এটি ‘সওগত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
- কবিতা: মুক্তি (১৯১৯)। এটি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’-য় প্রকাশিত হয়।
- প্রবন্ধ: তুর্কমহিলার ঘোমটা খোলা (১৯১৯)।
- গল্পগ্রন্থ: ব্যথার দান। এটি নজরুলের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ।
- কাব্যগ্রন্থ: অগ্নিবীণা (১৯২২)
- প্রবন্ধ গ্রন্থ: যুগবাণী (১৯২২)
- উপন্যাস: বাঁধনহারা (১৯২৭)
- নাটক: ঝিলিমিলি (১৯৩০)
পত্রিকা
কাব্যগ্রন্থ
অগ্নিবীণা (১৯২২)
- নজরুলের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ।
- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর অবক্ষয় ও ভারতের স্বাধীকার আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত।
- গ্রন্থে মোট ১২টি কবিতা আছে। প্রথম কবিতা ‘প্রলোয়োল্লাস’ এবং শেষ কবিতা ‘মোহররম’। এছাড়া অন্যান্য কবিতাগুলো হল: বিদ্রোহী, রক্তাম্বরধারিণী মা, আগমনী, ধূমকেতু,
- এ গ্রন্থের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্যই নজরুলকে ‘বিদ্রোহী’ কবি বলা হয়।
- কবি এ গ্রন্থটি বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে উৎসর্গ করেন। গ্রন্থটির সর্বাগ্রে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ-কে উৎসর্গ করে লেখা একটি উৎসর্গ কবিতা আছে। নজরুল নিজেকে বারীন্দ্রকুমারের ‘-হে-মহিমান্বিত শিষ্য’ বলে উল্লেখ করেছেন।
দোলনচাঁপা
- নজরুল জেলে থাকা অবস্থায় গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। স্ত্রী দোলন’র (ডাকনাম) নাম অনুসারে তিনি এ কাব্যের নামকরণ করেন।
- গ্রন্থটির প্রথম কবিতা ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’। কবিতাটি সূচিপত্রের আগে মুখবন্ধরূপে ছিল।
- গ্রন্থের কবিতাগুলো মূলত প্রেম প্রধান।
- উল্লেখযোগ্য কবিতা: বেলাশেষে, পুবের চাতক, অবেলার ডাক, অভিশাপ, সাধের ভিখারিণী, শেষ প্রার্থনা ইত্যাদি।
বিষের বাঁশি
- সরকার কর্তৃক নজরুলের প্রথম নিষিদ্ধ গ্রন্থ (১৯২৪)। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয় ১৯৪৫ সালে।
- উল্লেখযোগ্য কবিতা: আয়রে আবার আমার চির-তিক্ত প্রাণ, তূর্য নিনাদ, বন্দী-বন্দনা ইত্যাদি।
ভাঙার গান
- ১৯২৪ সালে প্রকাশিত এবং একই বছর সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ কাব্যগ্রন্থ।
- উল্লেখযোগ্য কবিতা – জাগরী, দুঃশাসনের রক্তপান ইত্যাদি।
সাম্যবাদী
- এটি মানবতাবাদী কাব্যগ্রন্থ।
- উল্লেখযোগ্য কবিতা: সাম্যবাদী, ঈশ্বর, মানুষ, বারাঙ্গনা, চোর-ডাকাত, কুলি-মজুর ইত্যাদি।
রুবাইৎ-ই-ওমর খৈয়াম
এটি নজরুলের অনুবাদ গ্রন্থ। ইরানের কবি ওমর খৈয়ামের কবিতাগুলো নজরুল এতে অনুবাদ করেছেন। সৈয়দ মুজতবা আলী এ গ্রন্থের ভূমিকা লেখেন।
সন্ধ্যা
বাংলাদেশের রণ সঙ্গীত ‘চল চল চল’ এ গ্রন্থের অন্তর্গত। কবিতাটি প্রথম ‘নতুনের গান’ নামে ‘শিখা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে কবিতাটিকে বাংলাদেশের রণসঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়। গান/কবিতাটির ২১ চরণ বাংলাদেশের রণ সঙ্গীত।
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ –
কাব্যগ্রন্থ | তথ্য |
---|---|
প্রলয় শিখা | এ কাব্যগ্রন্থের একটি বিখাত কবিতা ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’। এ কাব্য রচনার জন্য কবিকে ছয় মাস জেল খাটতে হয়েছে। |
সর্বহারা | |
চিত্তনামা | এটি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জীবনীভিত্তিক কাব্যগ্রন্থ। উল্লেখযোগ্য কবিতা: অর্ঘ্য, ইন্দ্রপতন, রাজভিখারী ইত্যাদি। |
ফণি-মনসা | উল্লেখযোগ্য কবিতা: সব্যসাচী, হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ ইত্যাদি। |
মরু-ভাস্কর | এটি হয়রত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনীভিত্তিক কাব্যগ্রন্থ। |
সিন্দু হিন্দোল | এ কাব্যগ্রন্থের একটি বিখাত কবিতা ‘দারিদ্র’। |
সাতভাই চম্পা | এটি কিশোর কাব্যগ্রন্থ। |
চক্রবাক | কবি চট্টগ্রামে অবস্থাকালীন সময়ের অধিকাংশ কবিতা এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। |
শেষ সওগাত | |
জিঞ্জির | |
নির্ঝর | |
নতুন চাঁদ |
সঞ্চিতা: নজরুল অনুমোদিত তার সেরা কবিতাগুলোর সমগ্র। এতে ৭৮ টি কবিতা আছে। এটি ১৯২৮ সালে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করে লিখেছেন “বিশ্বকবিসম্রাট শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রীশ্রীচরণারবিন্দেষু”।
উপন্যাস
- বাঁধনহারা
নাটক
- ঝিলিমিলি
- এটি নাট্যগ্রন্থ। এতে ৩টি নাটক আছে। নাটকগুলো হল: ঝিলিমিলি, সেতুবন্ধন, শিল্পী।
- আলেয়া
- মধুমালা
- পুতুলের বিয়ে
প্রবন্ধ
- যুগবাণী
- নজরুলের প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ।
- প্রবন্ধগুলোয় স্বদেশী চেতন ও ব্রিটিশ বিরোধী ভাব প্রকাশিত হয়েছে।
- উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ: নবযুগ, ধর্মঘট, সত্য শিক্ষা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, জাগরণী ইত্যাদি।
- রাজবন্দীর জবানবন্দী
- ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা রচনার জন্য নজরুলকে জেলে আটকে রাখার সময় তার বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি ৪ পৃষ্ঠার যে লিখিত বক্তব্য রাখেন তাই রাজবন্দীর জবানবন্দী নামে পরিচিত।
- যৌবনের গান
- রুদ্রমঙ্গল
- দুর্দিনের যাত্রী
গল্পগ্রন্থ
- ব্যাথার দান
- নজরুলের প্রথম গল্পগ্রন্থ।
- মোট ৬টি গল্প নিয়ে রচিত গ্রন্থ। গল্পগুলো: ব্যথার দান, হেনা, অতৃপ্ত কামনা, বাদল-বরিষণে, ঘুমের ঘোরে, রাজবন্দির চিঠি।
- রিক্তের বেদন
- উল্লেখযোগ্য গল্প: রিক্তের বেদন, বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী, দুরন্ত পথিক ইত্যাদি।
- শিউলিমালা
- উল্লেখযোগ্য গল্প: জিনের বাদশা, শিউলিমালা।
চলচ্চিত্র
- ধ্রুব: এটি নজরুল অভিনীত চলচ্চিত্র।
- ধূপছায়া: তিনি এ চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন।
সঙ্গীত গ্রন্থ
- বুলবুল
- চন্দ্রবিন্দু
- জুলফিকার ইত্যাদি
নিষিদ্ধ গ্রন্থ
কাজী নজরুলের ৫টি গ্রন্থ বিভিন্ন সময় নিষিদ্ধ হয়েছে। যথা:
গ্রন্থ | নিষিদ্ধ হয় |
---|---|
যুগবাণী | ১৯২২ |
বিষের বাশি | ১৯২৪ |
ভাঙার গান | ১৯২৪ |
প্রলয়শিখা | ১৯৩০ |
চন্দ্রবিন্দু | ১৯৩১ |
এছাড়া অগ্নিবীণা গ্রন্থের ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’ কবিতাটি নিষিদ্ধ হয়।
বিখ্যাত পঙ্কতি
কোন কালে একা হয়নি’ক জয়ী পুরুষের তরবারি,
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে, বিজয়-লক্ষ্মী নারী। – নারী (কবিতা)
সাম্যের গান গাই – আমার চোক্ষে পুরুষ-রমণী কোন ভেদাভেদ নাই। – নারী
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।
রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ। – নজরুলগীতি
গাহি সাম্যের গান, ধরণীর হাতে দিল যারা আনি ফসলের ফরমান। – জীবন বন্ধনা
হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান। – দারিদ্র্য
কাঁটা কুঞ্জে বসি তুই গাঁথিবি মালিকা,
দিয়া গেণু ভালে তোর বেদনার টীকা। – দারিদ্র্য
দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাপার। – কাণ্ডারী হুশিয়ার
আরও তথ্য:
- নজরুলের জীবনীভিত্তিক কাব্য – চিত্তনামা, মরুভাস্কর।
- নজরুল প্রথম ঢাকা আসেন – ১৯২৬ সালে। তিনি মোট ১৩ বার ঢাকা আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন ৫ বার।
- নজরুলকে কোলকাতা থেকে রাষ্ট্রীয় অতিথি করে ঢাকায় আনা হয় – ১৯৭২ সালে।
তথ্যসূত্র
- বাংলাপিডিয়া
- বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিঞ্জাসা – সৌমিত্র শেখর