চণ্ডীমঙ্গল মূলত পারস্পরিক যোগসূত্রহীন দুটি পৃথক কাহিনীর সমন্বয়। প্রাচীনতম কাহিনী আখেটিকখণ্ড এবং অপর কাহিনী বণিকখণ্ড তুলনামূলকভাবে নবীন। দুটি কাহিনীই আনুমানিক ১১০০ সালের।
আখেটিক খন্ড
উল্লেখযোগ্য চরিত্র: কালকেতু, ফুল্লরা, ভাঁড়ুদত্ত, ধনপতি সংদাগর, মুরারি শীল
দেবী চণ্ডী মর্ত্যে পূজা লাভের উদ্দেশ্যে মহাদেবকে (হিন্দু দেবতা) দিয়ে নীলাম্বরকে অভিশাপগ্রস্ত করে স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে পাঠান। অভিশপ্ত নীলাম্বর পৃথিবীতে কালকেতু নামে জন্মগ্রহণ করে। নীলাম্বরের সাথে তার স্ত্রী ছায়াও ব্যাধ কন্যা ফুল্লরা রূপে জন্মগ্রহণ করে।
কালকেতু ফুল্লরার দরিদ্র কিন্তু সুখী সংসার। কালকেতু বনে বনে পশু শিকার করে আর সেই পশুর মাংস ফুল্লরা হাটে হাটে বিক্রি করে। এদিকে কালকেতুর অত্যাচারে জর্জরিত এবং প্রায় নির্মূল কলিঙ্গ বনের পশুরা একসময় দেবী চণ্ডীর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। তাদের প্রার্থনায় সারা দিয়ে দেবী চণ্ডী স্বর্ণ গোধিকার (গুই সাপ) রূপ ধারণ করে কালকেতুর বনে যাওয়ার পথে শুয়ে থাকেন। কালকেতু সেই স্বর্ণ গোধিকাটিকে নিজের ধনুকের ছিলায় বেঁধে নেয়। দেবীর মায়ায় সেদিন কালকেতু বনের মধ্যে কোন পশু পায় না। খালি হাতে বাড়ি ফিরে এসে অমঙ্গলজনক স্বর্ণগোধিকাটিকে বেধে রেখে কালকেতু গোলাহাটে মাংস বিক্রি করতে যাওয়া ফুল্লরার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। হাটে ফুল্লরার সঙ্গে দেখা হলে কালকেতু তাকে গোধিকাটিকে শিক পোড়া করতে নির্দেশ দেয়। বাড়ি এসে ফুল্লরা দেখে এক সুন্দরী রমণী (দেবী চণ্ডী) ঘর আলো করে বসে আছে। ফুল্লরা সে নারীকে কালকেতুর নতুন স্ত্রী মনে করে এবং তাকে বিতাড়িত করার জন্য তার কাছে নিজের দুঃখের কাহিনী বর্ণনা করতে থাকে। কিন্তু সেই নারী কিছুতেই গৃহত্যাগ করতে চায় না। এতে ক্ষুব্ধ ফুল্লরা হাট থেকে কালকেতুকে ডেকে আনে। কালকেতু বাড়ি ফিরে গোধিকার পরিবর্তে সেই নারীকে দেখে বিস্মিত হয়। সে সেই রমণীকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলে। কিন্তু সে রাজি না হওয়ায় রাগান্বিত কালকেতু তার দিকে বাণ নিক্ষেপ করতে উদ্যত হয়। তখন সেই নারী দেবী চণ্ডীর নিজ মূর্তি ধারণ করে। দেবী কালকেতুকে সাত ঘড়া ধন এবং একটি মূল্যবান আংটি প্রদান করেন। তিনি কালকেতুকে বন কেটে গুজরাট নগর পত্তন করতে এবং মন্দির স্থাপন করে তার পুজা প্রচার করতে নির্দেশ দেন।
দেবীর কাছ থেকে প্রাপ্ত আংটি বিক্রি করার জন্য কালকেতু যায় বণিক মুরারি শীলের কাছে। মুরারি একজন ধূর্ত বণিক। সে কালকেতুকে প্রথমে ঠকানোর চেষ্টা করলেও দৈববাণী হওয়াই ভীত মুরারি শেষ পর্যন্ত আংটির প্রকৃত মূল্যই দেয়। এরপর কালকেতু বন কেটে গুজরাট নগর পত্তন করে। নানা দেশ থেকে বহু লোক এসে সেখানে বসবাস শুরু করে। কালকেতু গুজরাটে রাজত্ব করতে থাকে।
একসময় ভাঁড়ু দত্ত নামক ব্যক্তি কালকেতুকে হাত করে প্রজাদের উপর অত্যাচার করতে শুরু করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে কালকেতু তাকে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করলে ভাঁড়ুদত্ত এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কলিঙ্গরাজকে কালকেতুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে। কলিঙ্গরাজ কালকেতুর রাজ্য আক্রমণ করেন এবং কালকেতুকে বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। পরবর্তীতে দেবী চণ্ডীর আদেশে কলিঙ্গরাজ কালকেতুকে মুক্তি দেন। কালকেতু গুজরাটে ফিরে আসে এবং ভাঁড়ুদত্তকে শাস্তি প্রদান করে। এরপর কালকেতু দীর্ঘদিন রাজত্ব করে শেষে স্বর্গলোক গমন করে।
বণিক খন্ড
উল্লেখযোগ্য চরিত্র: ধনপতি সওদাগর, খুল্লনা, শ্রীমন্ত
দেবী চণ্ডী বণিক শ্রেষ্ঠ ধনপতি সওদাগরকে দিয়ে পৃথিবীতে নিজ পূজা প্রচার করতে চাইলেন। কিন্তু শিবভক্ত বণিক ধনপতি দেবী পূজায় অস্বীকৃতি জানায়।
স্বর্গের নর্তকী রত্নমালা নৃত্যকালে সামান্য তালভঙ্গ হওয়ায় আভিশাপগ্রস্ত হয়ে মর্ত্যলোকে ধনপতির প্রথম স্ত্রী লহমার খুড়তুত খুল্লনা নামে জন্মগ্রহণ করে। খুল্লনার রূপে মুগ্ধ হয়ে ধনপতি তাঁকে বিবাহ করে। কিছুদিন পরে ধনপতি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বিদেশে গমন করলে দুর্বলা নামক এক দাসীর প্ররোচনায় লহমা খুল্লনার উপর অত্যাচার শুরু করে। খুল্লরা এর মধ্যেই বনের রাখালদের কাছ থেকে চণ্ডীপূজা শিখে নেয় এবং মঙ্গলচন্ডীর ব্রত অনুষ্ঠান করতে শুরু করে। বাণিজ্য থেকে ফিরে এসে ধনপতি খুল্লারার ওপর নির্যাতনের বিষয়ে জানতে পারে এবং লহনাকে ভৎসনা করে। এরপর খুল্লনা যখন গর্ভবতী হয় তখন ধনপতি আবার বাণিজ্য যাত্রায় যায়। এ উপলক্ষ্যে খুল্লনা স্বামীর মঙ্গলকামনায় যখন চন্ডীর পূজা করেছিলেন তখন ধনপতি সেই ঘরে প্রবেশ করে পদাঘাতে পুজার ঘট ভেঙে দেয়। এতে দেবী চন্ডী ধনপতির উপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন এবং তাকে অপদস্ত করার উদ্দেশ্যে নিজ মায়ায় সিংহলের অনতিদূরে কালিদাহে হস্তীনিধনরত ‘কমলে কামিনী’ (দুর্গার রূপবিশেষ)-র দৃশ্য দেখাল। ধনপতি দেখতে পান পথের উপর এক নারী একবারে আস্ত হাতি গিলে ফেলছে এবং পরমুহূর্তে উগরে ফেলছে। সিংহলে উপনীত হয়ে ধনপতি সিংহল রাজকে এ কাহিনী বললে সিংহলের রাজা তা বিশ্বাস করলেন না। যখন ধনপতি সিংহল রাজকে কালিদহে নিয়ে গেলেন তখন ধনপাতি তাকে বর্ণিত দৃশ্য দেখাতে ব্যর্থ হয়, কারণ সেটি দেবীর মায়ার ফল ছিল। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সিংহল রাজ তাকে কারারুদ্ধ করলেন।
এদিকে স্বর্গভ্রষ্ট মালাধর খুল্লনার গর্ভজাত সন্তান হিসেবে শ্রীমন্ত নামে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে। সে বড় হয়ে নিরুর্দ্দিষ্ট পিতার সন্ধানে সমুদ্রযাত্রায় বের হয়। যথারীতি সেও পিতার মত কালিদহে কমলে কামিনী দেখে, তা সিংহল রাজকে তা বলে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিংহল রাজকে ঐ দৃশ্য দেখাতে ব্যর্থ হয়। ফলে সিংহল রাজ তাকেও বন্দি করে কারাগারে প্রেরণ করেন। এতে কারাগারের মধ্যে পিতা পুত্রের মিলন হয়। তারপর তারা দুজনেই দেবী চণ্ডীর স্তব করলে দেবী সন্তুষ্ট হয়ে পিতা-পুত্রকে মুক্ত করতে সিংহল রাজকে স্বপ্নে নির্দেশ দেন। দেবীর নির্দেশে সিংহল রাজ উভয়কেই মুক্তি দেন এবং নিজ কন্যা সুশীলার সঙ্গে শ্রীমন্তের বিয়ে দেন। পরিশেষে ধনপতি পুত্র ও পুত্রবধূ নিয়ে দেশে ফিরে এসে মহাসমারোহে দেবী চণ্ডীর পূজো করেন। এভাবে মর্ত্যলোকে দেবীর পূজা প্রচলিত হয়।