চতুর্থ শিল্প বিপ্লব

Estimated Reading Time: 13 Minutes

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা Fourth Industrial Revolution (4IR) বা Industry – 4 সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক উত্থানের একটি সময়কাল নির্দেশ করে যা ২১ শতকে উন্মোচিত হবে। এটি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্প ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি প্রক্রিয়া। ২০১১ সালে জার্মান সরকারের একটি হাই টেক প্রকল্প থেকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শব্দটির উৎপত্তি। তবে একে সর্বপ্রথম বৃহৎ পরিসরে তুলে আনেন ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারম্যান ক্লস শোয়াব। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মূলত তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বিপ্লব। এ বিপ্লব অর্জনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে ক্লাউড কম্পিউটিং, ইন্টারনেট অব থিংস (IoT) এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) – এর মত আধুনিক প্রযুক্তি।

এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে মোট তিনটি শিল্পবিপ্লব ঘটেছে। এ শিল্পবিপ্লবগুলো বিশ্বের গতিপথ বদলে দিয়েছে। প্রথম বিপ্লবটি বাষ্পীয় ইঞ্জিন, দ্বিতীয়টি বিদ্যুৎ, তৃতীয়টি ইন্টারনেটের উপর ভিত্তি করে সংঘটিত হয়েছিল। চতুর্থ বিপ্লবটি ডিজিটাল তথ্য প্রযুক্তির ওপর ভর করে সংঘটিত হবে। উল্লেখ্য বিপ্লবগুলোকে অন্যভাবেও ভাগ করা যায়। যেমন: প্রথম বিপ্লবটি কয়লা, দ্বিতীয়টি তেল, তৃতীয়টি গ্যাস ও চতুর্থটি নবায়নযোগ্য জ্বালানি।

অষ্টাদশ শতকে প্রথম শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয় স্টিম বা বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের নানামুখী ব্যবহারের কৌশল আবিষ্কারের মাধ্যমে উৎপাদন ও পরিবহনের ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা হয়। এসময় জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার ছিল প্রধান ভিত্তি। এক পর্যায়ে ট্রেন সবচেয়ে অগ্রসর পরিবহন হিসেবে আবির্ভূত হয়।

এরপর ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ আবিষ্কৃত হলে একেবারেই পাল্টে যায় মানুষের জীবনের চিত্র। কায়িক পরিশ্রমের জায়গা দখল করে নেয় বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রপাতি। ফলে কায়িক শ্রমের প্রয়োজন দ্রুততর গতিতে কমতে থাকে। এটিকে বলা হয় দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব। এসময় তেল ও বিদ্যুৎ ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত শিল্পায়ন, ব্যাপকভিত্তিক উৎপাদনের বিকাশ ঘটে।

দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের ঠিক ১০০ বছরের মাথায় ১৯৬৯ সালে আবিষ্কৃত ইন্টারনেট হয়। ফলে শুরু হয় ইন্টারনেটভিত্তিক তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। ইন্টারনেটের আবির্ভাবে সারা বিশ্বের গতি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। যাত্রা শুরু হয় ভার্চুয়াল জগতের। ইলেকট্রনিকস এবং তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন ও যোগাযোগের সুযোগ বিস্তৃত হয়।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আসছে ভার্চুয়াল জগতেরই আরও বিস্তৃত পরিসর নিয়ে। যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ইন্টারনেট অব থিংস বা যন্ত্রের ইন্টারনেট সম্পূর্ণ রূপেই মানবসম্পদের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে! এই বিপ্লবের ছোয়ায় উৎপাদন ব্যবস্থার অকল্পনীয় পরিবর্তন ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে। উৎপাদনের জন্য মানুষকে যন্ত্র চালাতে হবেনা, বরং যন্ত্র সয়ংক্রীয়ভাবে নিখুঁত ও নির্ভূল কর্ম সম্পাদন করবে।

আগের বিপ্লবগুলোয় শারীরিক শ্রমের যে ক্রমহ্রাসমান গুরুত্ব ছিল, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে তা আরও ব্যাপকভাবে কমে যাবে। সেখানে স্থান নেবে মানুষের মেধাশ্রম ও যন্ত্র। মিন জু ও অন্যরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হলো:

(১) উৎপাদন ও বাজারের মধ্যে দূরত্ব হ্রাস
(২) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সর্বব্যাপী ব্যবহার
(৩) বিভিন্ন প্রযুক্তির মিশ্রণ
(৪) দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় রোবটের ব্যবহার বৃদ্ধি
(৫) ইন্টারনেটের মাধ্যমে সবকিছু পরস্পর সম্পর্কিত।

সুবিধা

  • অটোমেশনের প্রভাবে কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি হ্রাস পাবে। মানবশ্রম ছাড়াই বহু রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ সমাধান করার পথ প্রশস্ত হবে।
  • উৎপাদন শিল্পে নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পাবে।
  • স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে বড় পরিবর্তন তথা উন্নয়ন সূচিত হবে।
  • বিশেষায়িত পেশার চাহিদা বৃদ্ধি পাবে।
  • সামগ্রিক জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হবে।
  • স্থানিক যোগাযোগ অতিক্রম করে বৈশ্বিক যোগাযোগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান-শিক্ষা-গবেষণা-চিকিৎসাসেবার সুযোগ তৈরি হয়েছে
  • জিন প্রযুক্তি মানুষের সীমিত ক্ষমতা অতিক্রম করার সুযোগ তৈরি হবে।

অসুবিধা

  • গোটা দুনিয়ার একটি বিশাল অঙ্কের মানুষের কাজ হারানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।
  • মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয় বিষয়গুলো হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।
  • চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সমাজে বৈষম্য তৈরি করতে পারে। যেমন ‘কম-দক্ষতা স্বল্প-বেতন’ বনাম ‘উচ্চ-দক্ষতা উন্নত-বেতন’ কাঠামো অর্থনৈতিক বিভাজন সৃষ্টি করবে।

বাংলাদেশের জন্য ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল ভোগ করার সব থেকে বড় হাতিয়ার হল তরুণ জনশক্তি। জ্ঞানভিত্তিক এই শিল্প বিপ্লবে প্রাকৃতিক সম্পদের চেয়ে দক্ষ মানবসম্পদই হবে বেশি মূল্যবান। ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে বিপুল পরিমাণ মানুষ চাকরি হারালেও এর বিপরীতে সৃষ্টি হবে নতুন ধারার জ্ঞান ও দক্ষতানির্ভর নানাবিধ কর্মক্ষেত্র। তাই ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের সুযোগকে কাজে লাগাতে হলে আমাদের প্রধানতম লক্ষ্য হতে হবে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী সুদক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি, আর এজন্য প্রয়োজন হবে শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন।

গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান

বাংলাদেশে বর্তমানে তরুণের সংখ্যা ৪ কোটি ৭৬ লাখ (২০২১) যা মোট জনসংখ্যার ৩০%। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আগামী ৩০ বছর জুড়ে তরুণ বা উৎপাদনশীল জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবে।

আরও পড়ুন – চতুর্থ শিল্প বিপ্লব : ব্যাংকিং খাতের চ্যালেঞ্জ ও প্রস্তুতি

Leave a Reply