ণ-ত্ব ও ষ-ত্ব বিধান

Estimated Reading Time: 17 Minutes

খাঁটি বাংলা বা বিদেশি শব্দে মূর্ধন্য বর্ণ লেখার প্রয়োজন হয় না। তবে তৎসম বা সংস্কৃত শব্দে মূর্ধন্য বর্ণের প্রয়োজন হয়। সংস্কৃত শব্দে বানান ও তার উচ্চারণ রীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলা ভাষার যে সব শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে নেওয়া হয়েছে, সে সব শব্দে সংস্কৃত ভাষার বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে। এসব শব্দের জন্যই বাংলা ব্যাকরণে ণ-ত্ব বিধান ও ষ-ত্ব বিধান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। উল্লেখ্য যে, বাংলায় মূর্ধন্য-ণ ও দন্ত্য-ন এর উচ্চারণ একই।

ণ-ত্ব বিধান

বাংলা (দেশি), তদ্ভব ও বিদেশি শব্দের বানানে মূর্ধন্য-ণ বর্ণ লেখার প্রয়োজন হয় না। বাংলা ভাষায় ‘ণ’ ব্যবহৃত হয় শুধু তৎসম শব্দে। তৎসম শব্দের বানানে ণ ব্যবহারের নিয়মগুলোকে ণ-ত্ব বিধান বলে।

ণ-ব্যবহারের নিয়ম

ট-বর্গীয় ধ্বনির (ট, ঠ, ড, ঢ) পূর্বে তৎসম শব্দে সবসময় মূর্ধন্য-ণ হয়। যেমন:

  • ঘণ্টা (ণ্ট = ণ্ + ট)
  • বণ্টন
  • লুণ্ঠন
  • খণ্ড (ণ্ড = ণ্ + ড) ইত্যাদি।

ঋ, র, ষ বর্ণের পরে মূর্ধন্য-ণ হয়। যেমন:

  • ঋণ
  • তৃণ
  • বর্ণ
  • বর্ণনা
  • উদাহরণ
  • আচরণ
  • অরণ্য
  • অক্ষুণ্ণ
  • আবরণ
  • আচরণ
  • উচ্চারণ
  • কারণ
  • জাগরণ
  • ধারণা
  • ব্যাকরণ
  • লক্ষণ
  • আমন্ত্রণ (ন্ত্র = ন্ + ত্ + র)
  • ঘ্রাণ (ঘ্র = ঘ্ + র)
  • অর্ণব (র্ণ = র্ + ণ)
  • অন্বেষণ
  • আকর্ষণ
  • বর্ধিষ্ণু (ষ্ণ = ষ্ + ণ)
  • প্রশিক্ষণ (ক্ষ = ক্ + ষ) ইত্যাদি।

যদি ঋ, র, ষ বর্ণের পরে স্বরবর্ণ, ক-বর্গ, প-বর্গ, য, ব, হ, য় অথবা অনুস্বর (ং) থাকে, তার পরে মূর্ধন্য-ণ হয়। যেমন:

  • কৃপণ (ঋ কারের পরে প, তার পরে ণ)
  • নির্বাণ
  • গ্রহণ ইত্যাদি।

প্র, পরা, পরি, নির – এ চারটি উপসর্গের পর স্বরবর্ণ থাকলে কৃৎ প্রত্যয়ে ণ-হয়। যেমন:

  • পরিণত
  • প্রণাম
  • প্রমাণ
  • প্রণীত
  • নির্ণয় ইত্যাদি।

কতগুলো শব্দে স্বভাবতই মূর্ধন্য-ণ হয়। যেমন: (ছন্দ আকারে)

চাণক্য মাণিক্য গণ          বাণিজ্য লবণ মণ
          বেণু বীণা কঙ্কণ কণিকা।
কল্যাণ শোণিত মণি          স্থাণু গুণ পুণ্য বেণী
          ফণী অণু বিপণি গণিকা।
আপণ লাবণ্য বাণী          নিপুণ ভণিতা পাণি
         গৌণ কোণ ভাণ পণ শাণ।
চিক্কণ নিক্কণ তূণ          কফণি (কনুই) বণিক গুণ
          গণনা পিণাক পণ্য বাণ।

উল্লেখ্য এখানে শোণিত অর্থ রক্ত, স্থাণু অর্থ স্থির/নিশ্চল, বিপণি অর্থ বিক্রয়কেন্দ্র, গণিকা অর্থ যৌনকর্ম করে যারা, আপণ অর্থ দোকান, পাণি অর্থ হাত, ভাণ অর্থ সংস্কৃত নাটকবিশেষ, চিক্কণ অর্থ সুপারি গাছ বা স্নিগ্ধ/মসৃণ, নিক্কণ অর্থ ধ্বনি/শব্দ, তূণ অর্থ যাতে বাণ রাখা হয় বা নিষঙ্গ, পিণাক অর্থ ত্রিশূল।

কোথায় ণত্ব বিধান খাটে না?

নিম্নক্তো ক্ষেত্রগুলোতে ণ-তত্ত্ব বিধানের নিয়মাবলি খাটে না-

  • ত-বর্গের (ত, থ, দ, ধ) ধ্বনির সাথে দন্ত্য-ন হয়। যেমন: বৃন্ত, বৃন্দ, গ্রন্থ ইত্যাদি।
  • বাংলা ক্রিয়াপদের অন্তঃস্থিত দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয় না। যেমন: ধরেন, মারেন, করেন, যাবেন, খাবেন, হবেন, নিবেন, দিবেন ইত্যাদি।
  • বিদেশী শব্দে দন্ত্য-ন হয়। যেমন: কোরআন, জার্মান, জবান, নিশান, ফরমান, রিপন ইত্যাদি।
  • পূর্বপদে ঋ, র, ষ থাকলে পরপদে মূর্ধন্য-ণ হয় না। যেমন: মৃগনাভি, দুর্নাম, ত্রিনেত্র, মৃন্ময়।
  • সমাসবদ্ধ শব্দে ণ-ত্ব বিধান খাটে না। যেমন: ত্রিনয়ন, সর্বনাম ইত্যাদি।

ষত্ব বিধান

যেসব তৎসম শব্দে ‘ষ’ রয়েছে তা বাংলায় অবিকৃত আছে। তৎসম শব্দের বানানে ষ এর সঠিক ব্যবহারের নিয়মই ষত্ব বিধান।

ষ ব্যবহারের নিয়ম

অ, আ বাদে অন্য স্বরধ্বনি, ক ও র- এরপরের প্রত্যয়াদির দন্ত্য-স মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন:

  • ভবিষ্যৎ (ভ + অ + ব + + ষ + …)
  • পরিষ্কার, আবিষ্কার
  • মুমূর্ষু
  • চিকির্ষা (চ + ই + ক + ই + র্ + ষ +…)

অতি, অভি এমন শব্দের শেষে ই-কার উপসর্গ এবং অনু ও সু উপসর্গের পরে কতগুলো ধাতুর দন্ত্য-স মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন:

  • অতিষ্ঠ
  • অনুষ্ঠান
  • নিষেধ
  • অভিষেক
  • বিষণ্ন(‘ণ্ন’ মূর্ধ-ণ পরে দন্ত্য-ন)
  • সুষম ইত্যাদি

ঋ-কারে পরে মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন:

  • ঋষি
  • কৃষক
  • বৃর্ষা, বর্ষণ, বৃষ্টি
  • তৃষ্ণা ইত্যাদি

র-ধ্বনির পরে যদি অ, আ ভিন্ন অন্য ধ্বনি থাকে তবে তার পরে ষ হয়। যেমন: পরিষ্কার, আবিষ্কার। কিন্তু অ,আ থাকলে স হয়। যেমন: পুরস্কার।

নিঃ, দুঃ, বহিঃ, আবিঃ, চতুঃ, প্রাদুঃ এ শব্দগুলোর পর ক্‌, খ্‌, প্‌, ফ্‌ থাকলে বিসর্গ (ঃ) এর জায়গায় মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন: নিঃ + কাম > নিষ্কাম, দুঃ + কর > দুষ্কর, বহিঃ + কার > বহিষ্কার, নিঃ + পাপ > নিষ্পাপ।

ট ও ঠ এর সঙ্গে যুক্ত থাকলে ষ হয়। যেমন: স্পষ্ট, কাষ্ট ইত্যাদি।

কিছু শব্দ স্বভাবতই মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন: আষাঢ়, নিষ্কর, পাষাণ, ষোড়শ ইত্যাদি।

কতগুলো শব্দ বিশেষ নিয়মে মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন: আষাঢ়, ষোড়শ, আভাষ, অভিলাস, পোষণ, পাষাণ, তোষণ, শোষণ, বিষাণ, সুষুপ্তি, বিষম, বিষয়, দুর্বিষহ, যুধিষ্ঠির ইত্যাদি।

কোথায় ষত্ব বিধান নিষেধ বা খাটে না?

  • সাৎ প্রত্যয়ের দন্ত্য-স মূর্ধন্য-ষ হয় না। যেমন-
    • ভূমিসাৎ, ধূলিসাৎ, আকস্মাৎ।
  • খাঁটি বাংলা ও বিদেশী শব্দে মূর্ধন্য-ষ হয় না। যেমন-
    • টেক্স, পুলিশ, জিনিস, মিসর, গ্রিস, স্টেশন, মুসাবিদা।
  • অঃ বা আঃ থাকলে তার পরে ক্‌, খ্‌, প্‌, ফ্‌ সন্ধিযুক্ত হলে বিসর্গ (ঃ) এর জায়গায় দন্ত্য-স হয়। যেমন-
    • পুরঃ + কার = পুরস্কার, ভাঃ + কর = ভাস্কর, তিরঃ + কার = তিরস্কার, পরঃ+ পর= পরস্পর, স্বতঃ + ফূর্ত= স্বতঃস্ফূর্ত
  • অঃ বা আঃ থাকলে তার পরে ক্‌, খ্‌, প্‌, ফ্‌ ছাড়াও ত থাকলেও স হতে পারে। যেমন-
    • মনঃ+ তাপ = মনস্তাপ, শিরঃ + ত্রাণ= শিরস্ত্রাণ।

এক নজরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন

ণ-ত্ব ও ষ-ত্ব বিধান কাকে বলে? উ: ণ-ত্ব ও ষ-ত্ব বিধান বাংলা ব্যাকরণের বিশেষ নিয়ম। বাংলা ভাষার অন্তর্গত শব্দে ণ ও ষ ব্যবহারের যে নিয়ম তাকে যথাক্রমে ণ-ত্ব ও ষ-ত্ব বিধান বলে।

ণ-ত্ব ও ষ-ত্ব বিধান ব্যাকরণের কোন অংশে আলোচিত হয়? উ: ধ্বনিতত্ত্বে। কারণ এটি ধ্বনি সম্বন্ধীয় বিষয়।

ণ-ত্ব ও ষ-ত্ব বিধান কোন শব্দের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? উ: বাংলা ভাষায় ৫ প্রকার শব্দ রয়েছে। যথা: তৎসম, অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব, দেশি ও বিদেশি। এর মধ্যে শুধু তৎসম শব্দের বানানের ক্ষেত্রে ণ-ত্ব ও ষ-ত্ব বিধান প্রযোজ্য।

কোন শব্দে সাধারণত ণ-ত্ব বিধান প্রযোজ্য নয়? উ: তৎসম শব্দ ব্যতিত অন্যান্য শব্দের ক্ষেত্রে ণ-ত্ব ও ষ-ত্ব বিধান প্রযোজ্য নয়।

Reference: Wikipedia

Quiz

39

1 / 10

ণ-ত্ব বিধান বাংলা বানানে কোন শব্দের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য?

2 / 10

নিচের কোন বানানটি শুদ্ধ?

3 / 10

নিত্য মূর্ধন্য ণ-বাচক শব্দ কোনটি?

4 / 10

শুদ্ধ বানান কোনটি?

5 / 10

'মাণিক্য' শব্দে 'ণ' বসেছে ণ-ত্ব বিধানের কোন নিয়মে?

6 / 10

কোন শব্দটির বানান সঠিক?

7 / 10

নিচের কোন বানানে মূর্ধন্য 'ণ' ব্যবহার হয়েছে?

8 / 10

নিত্য মূর্ধন্য ষ কোন শব্দে বর্তমান?

9 / 10

কখন 'ন' হয় না?

10 / 10

কোন প্রত্যয়যুক্ত পদে মূর্ধন্য ষ হয় না?

Your score is

The average score is 65%

0%

Recent Posts

বাংলা ভাষা ও সাহিত্য

Leave a Reply