দ্বিরুক্ত শব্দ

Estimated Reading Time: 23 Minutes

দ্বিরুক্ত (= দ্বি+উক্ত) অর্থ দুইবার উক্ত হয়েছে এমন। বাংলা ভাষায় অনেক শব্দ, পদ বা অনুকার শব্দ দুইবার ব্যবহৃত হয়ে একটি বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে। অর্থ্যাৎ শব্দটি একবার ব্যবহার করলে যে অর্থ প্রকাশ করত, একই শব্দ দুইবার ব্যবহার করলে তা পূর্বের তুলনায় সম্প্রসারিত বা সংকুচিত অর্থ প্রকাশ করে থাকে। যেমন:

  • ‘বড় বই’ – শব্দগুচ্ছ দ্বারা সাধারণত একটি বড় বইকে বোঝায়। কিন্তু ‘বড় বড় বই’ শব্দগুচ্ছ দ্বারা ঠিক একই অর্থ প্রকাশিত হয় না, বরং তার তুলনায় আরও সম্প্রসারিত অর্থ প্রকাশিত হয় (অনেক বইকে বোঝায়)।
  • ‘জ্বর এসেছে’ শব্দগুচ্ছ দ্বারা জ্বরের যে মাত্রা বোঝায় ‘জ্বর জ্বর লাগছে’ শব্দগুচ্ছ দ্বারা তার তুলনায় জ্বরের সংকুচিত মাত্রা প্রকাশিত হয়।

এধরণের শব্দগুচ্ছই দ্বিরুক্ত শব্দ। সুতরাং একটি শব্দ বা পদ পরপর দুইবার ব্যবহৃত হয়ে কোন বিশেষ অর্থ প্রকাশ করলে তাকে দ্বিরুক্ত শব্দ বলে। দ্বিরুক্ত শব্দ দ্বারা মূলত কোন শব্দের অর্থের কম/সংকোচন বা বেশি/প্রসারণ বোঝানো হয়। যেমন: ‘আমার জ্বর জ্বর লাগছে।’ এখানে ‘জ্বর জ্বর’ দ্বিরুক্ত শব্দটি ঠিক ‘জ্বর’ অর্থ প্রকাশ করছে না। জ্বরের ভাব (জ্বর তুলনামূলক কম) প্রকাশ করছে।

দ্বিরুক্তি শব্দের মাধ্যমে ভাষায় নতুন শব্দ তৈরি হয়। ফলে ভাষা সমৃদ্ধ হয়। বিভিন্ন প্রকার দ্বিরুক্ত শব্দ –

  • শব্দের দ্বিরুক্তি
  • পদের/পদাত্মক দ্বিরুক্তি
  • অনুকার দ্বিরুক্তি

শব্দের দ্বিরুক্তি

একই শব্দ অবিকৃতভাবে দুইবার ব্যবহৃত হয়ে (ভাল ভাল, ফোঁটা ফোঁটা, বড় বড় ইত্যাদি।) অথবা সহচর শব্দযোগে (‘কাপড়-চোপড়’) শব্দের দ্বিরুক্তি গঠিত হয়। দুটি সম্পর্কিত শব্দকে সহচর শব্দ বলা যায়। যেমন: ‘কাপড়’ অর্থ গা ঢাকার জন্য যা পড়া হয়। আর কাপড়ের সঙ্গে অনুষঙ্গ হিসেবে যেগুলো পরা হয় সেগুলোই ‘চোপড়’। অর্থাৎ ‘কাপড়-চোপড়’ দুটি শব্দ পরস্পর সম্পর্কিত। তাই এই দুটি শব্দ সহচর শব্দ। অনুরূপভাবে: লালন-পালন, খোঁজ-খবর ইত্যাদি সহচর শব্দ।

একই শব্দ পরেরবার একটু পরিবর্তিত হয়েও শব্দের দ্বিরুক্তি গঠিত হয়। যেমন: মিট-মাট, ফিট-ফাট, বকা-ঝকা, তোড়-জোড়, গল্প-সল্প, রকম-সকম ইত্যাদি।

সমার্থক বা বিপরীতার্থক শব্দযোগেও শব্দের দ্বিরুক্তি গঠিত হয়ে থাকে। যেমন:

  • সমার্থক শব্দযোগে: ধন-দৌলত, বলা-কওয়া, টাকা-পয়সা ইত্যাদি।
  • বিপরীতার্থক শব্দযোগে: লেন-দেন, দেনা-পাওনা, ধনী-গরিব, আসা-যাওয়া ইত্যাদি।

পদের দ্বিরুক্তি

পদ বা বিভক্তিযুক্ত শব্দ দুইবার ব্যবহৃত হয়ে কোন বিশেষ অর্থ প্রকাশ করলে তাকে পদের দ্বিরুক্তি বা পদাত্মক দ্বিরুক্তি বলে। পদাত্মক দ্বিরুক্তি নিম্নোক্তভাবে গঠিত হতে পারে-

একই পদ অবিকৃতভাবে পরপর দুইবার ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন:

  • ঘরে ঘরে (ঘর + এ) লেখাপড়া হচ্ছে।
  • দেশে দেশে ধন্য ধন্য পড়ে গেলো।
  • মনে মনে আমিও এ কথাই ভাবছিলাম।
  • ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলাম।
  • হাটে হাটে বিকিয়ে তোর ভরা আপণ। 
  • খাঁচার ফাঁকে ফাঁকে।
  • পরশে মুখে মুখে।
  • নিরবের চোখে চোখে। 

দ্বিতীয় পদ কিছুটা পরিবর্তিত হয়েও পদের দ্বিরুক্তি গঠিত হতে পারে। তবে এক্ষেত্রেও পদ-বিভক্তি অপরিবর্তিত থাকে। অর্থাৎ, মূল শব্দ কিছুটা পরিবর্তিত হয়, কিন্তু বিভক্তি অপরিবর্তিত থাকে। যেমন:

  • আমরা হাতে (হাত + এ)-নাতে (নাত + এ) চোরটাকে ধরেছি।
  • আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে

সহচর, সমার্থক বা বিপরীতার্থক শব্দ একই বিভক্তি যুক্ত হয়ে পরপর ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন:

  • দেশে বিদেশে বইটি লিখেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী
  • পথে-প্রবাসে লিখেছেন মুহম্মদ এনামুল হক

যুগ্মরীতিতে গঠিত দ্বিরুক্ত পদের ব্যবহার। যথা:

  • হাতে-হাতে
  • আকাশে-বাতাসে
  • কাপড়-চোপড়
  • দলে-বলে ইত্যাদি

পদের দ্বিরুক্তির প্রয়োগ

বিশেষ্য পদের দ্বিরুক্তি

উল্লেখ্য, বিশেষ্য পদের দ্বিরুক্তি হলে সেগুলো বিশেষণ পদের মত কাজ/ আচরণ করে। অর্থাৎ, বিশেষ্য পদের দ্বিরুক্তি হলে সেগুলো বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

আধিক্য বোঝাতে

  • তার কোষাগারে রাশি রাশি ধন
  • করিমের গোলায় ধামা ধামা ধান

পরস্পরতা বা ধারাবাহিকতা বোঝাতে

  • তুমি দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছ।
  • সেচ্ছাসেবকরাবাড়ি বাড়ি হেঁটে চাঁদা তুলছে।

অনুরূপ কিছু বোঝাতে

  • করিমের সঙ্গী সাথী কেউ নেই।

সামান্য বোঝাতে

  • আমার জ্বর জ্বর লাগছে।
  • তার কবি কবি ভাব।

ক্রিয়া বিশেষণ

  • সে ধীরে ধীরে যায়
  • ফিরে ফিরে চায়

আগ্রহ বোঝাতে

  • ছেলেটি দাদা দাদা বলে ডাকছে।

বিশেষণ পদের দ্বিরুক্তি

আধিক্য বোঝাতে

  • ভাল ভাল আম।
  • ছোট ছোট ডাল।

তীব্রতা বা সঠিকতা বোঝাতে

  • গরম গরম জিলাপী।
  • নরম নরম হাত।

সামান্যতা বোঝাতে

  • উড়ু উড়ু ভাব।
  • কাল কাল চেহারা।

সর্বনাম পদের দ্বিরুক্তি

  • বহুবচন বা আধিক্য বোঝাতে: সে সে লোক কোথায় গেল?, কে কে এল?, কেউ কেউ বলে।

ক্রিয়াপদের/ ক্রিয়াবাচক পদের দ্বিরুক্তি

বিশেষণ রূপে

  • রোগীর তো যায় যায় অবস্থা।
  • তোমার নেই নেই ভাব আর গেল না।

ক্রিয়া বিশেষণ

  • দেখে দেখে যাও।
  • ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শুনলে কিভাবে?

স্বল্পকাল স্থায়ী বোঝাতে

  • দেখতে দেখতে আকাশ কাল হয়ে এল।

পৌনঃপুনিকতা বোঝাতে

  • ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে গেছি।

অব্যয় পদের দ্বিরুক্তি

ভাবের গভীরতা বোঝাতে

  • সবাই হায় হায় করতে লাগল।
  • ছি ছি, তুমি এত খারাপ!

পৌনঃপুনিকতা বোঝাতে

  • বার বার সে কামান গর্জে উঠল।

অনুভূতি বা ভাব বোঝাতে

  • ভয়ে গা ছম ছম করছে।
  • ফোঁড়াটা টন টন করছে।

বিশেষণ বোঝাতে

  • পিলসুজে বাতি জ্বলে মিটির মিটির।

ধ্বনিব্যঞ্জনা

  • ঝির ঝির করে বাতাস বইছে।
  • বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর।

বিশিষ্টার্থক বাগধারায় দ্বিরুক্তি শব্দের প্রয়োগ: 

  • ছেলেটিকে চোখে চোখে রেখো । (সতর্কতা) 
  • ফুলগুলো তুই আনরে বাছা বাছা । (ভাবের প্রগাঢ়তা) 
  • থেকে থেকে শিশুটি কাঁদছে । (কালের বিস্তার) 
  • লোকটা হাড়ে হাড়ে শয়তান । (আধিক্য)

যুগ্মরীতিতে দ্বিরুক্ত

একই শব্দ ঈষৎ পরিবর্তন করে দ্বিরুক্ত শব্দ গঠনের রীতিকে বলে যুগ্মরীতি। যুগ্মরীতিতে দ্বিরুক্ত গঠনের কয়েকটি নিয়ম রয়েছে। যেমন:

  • শব্দের আদি স্বরের পরিবর্তন করে: চুপচাপ, মিটমাট, জারিজুরি,
  • শব্দের অন্ত্যস্বরের পরিবর্তন করে: মারামারি, হাতাহাতি, সরাসরি, জেদাজেদি ।
  • দ্বিতীয়বার ব্যবহারের সময় ব্যঞ্জনধ্বনির পরিবর্তন: ছটফট, নিশপিশ, ভাতটাত ।
  • সমার্থক বা একার্থক সহচর শব্দ যোগে: চালচলন, রীতিনীতি , বনজঙ্গল , ভয়ডর ।
  • ভিন্নার্থক শব্দ যোগে: ডালভাত ,তালা চাবি, পথঘাট, অলিগলি ।
  • বিপরীতার্থক শব্দ যোগে: ছোট-বড়, আসা-যাওয়া, জম্ম-মৃত্যু, আদান-প্রদান ।

ধ্বন্যাত্মক/অনুকার দ্বিরুক্তি:

ধ্বন্যাত্মক শব্দের দুইবার প্রয়োগকে ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি বলে। ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি দ্বারা বহুত্ব, আধিক্য ইত্যাদি বোঝায়। ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি শব্দ কয়েকটি উপায়ে গঠিত হয়। মানুষ, জীবজন্তু বা বস্তুর ধ্বনির অনুকার বা অনুভূতিজাত কাল্পনিক ধ্বনির অনুকার দিয়েও ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্ত শব্দ গঠিত হয়। যেমন: ভেউ ভেউ (মানুষের উচ্চস্বরে কান্নার ধ্বনি), ঘেউ ঘেউ (কুকুরের ধ্বনি), মড়মড় (গাছ ভেঙ্গে পড়ার শব্দ), ঠা ঠা (রোদের তীব্রতা) ইত্যাদি । অনুরূপভাবে – ট্যা ট্যা, হি হি, মিউ মিউ, কুহু কুহু, কা কা, ঘচাঘচ (ধান কাটার শব্দ), ঝমঝম, হু হু, ঝিকিমিকি (ঔজ্জ্বল্য), কুট কুট, মিন মিন, পিট পিট, ঝি ঝি ইত্যাদি ধন্যাত্মক/অনুকার দ্বিরুক্তি শব্দ।

ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি গঠন:

  • একই (ধ্বন্যাত্মক) শব্দের অবিকৃত প্রয়োগ: ধব ধব , ঝন ঝন , পট পট
  • প্রথম শব্দের শেষে ‘আ’ যোগ করে: গপাগপ, টপাটপ, পটাপট
  • দ্বিতীয় শব্দটির শেষে ‘ই’ যোগ করে: ধরাধরি, ঝমঝমি, ঝনঝনি
  • যুগ্মরীতিতে গঠিত শব্দ: কিচির মিচির , টাপুর টুপুর, হাপুস হুপুস
  • আনি-প্রত্যয় যোগে গঠিত শব্দ: পাখিটার ছটফটানি দেখলে কষ্ট হয়। তোমার বকবকানি আর ভালো লাগে না।

শব্দ ও পদ দ্বিরুক্তির মধ্যে পার্থক্য –

ধ্বনির সমষ্টি নিয়ে শব্দ গঠিত হয় এবং এই শব্দগুলো যখন বিভক্তিযুক্ত হয়ে বাক্যে ব্যবহৃত হয় তখন তাকে পদ বলে। অর্থ্যাৎ বাক্যে ব্যবহৃত শব্দগুলোই পদ। শব্দের সাথে বিভক্তি যুক্ত থাকে না, কিন্তু পদে বিভক্তি যুক্ত থাকে। আবার শব্দ এককভাবে থাকে, একটি শব্দের সাথে অন্য শব্দের কোন সংশ্লিষ্টতা থাকে না। পক্ষান্তরে পদগুলো অন্য পদের সাথে সম্পর্কিত/সংশ্লিষ্ট থাকে। সহজভাষায়, পদ বাক্যে ব্যবহৃত হয় আর শব্দের সাথে বাক্যের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। শব্দ দ্বিরুক্তিতে ‘মূল শব্দের’ সাথে বিভক্তি যুক্ত হয় না কিন্তু অর্থের পরিবর্তন হয়। অপরদিকে পদের দ্বিরুক্তিতে বিভক্তি যুক্ত থাকে এবং দ্বিতীয় পদের ধ্বনিগত পরিবর্তন হয়, কিন্তু বিভক্তির পরিবর্তন হয় না।

45

দ্বিরুক্ত শব্দ

বিগত সালের প্রশ্ন

1 / 18

সমার্থক শব্দ যোগে দ্বিরুক্তি হয়েছে কোনটি?

2 / 18

'বই-টই' নিয়ে পড়তে বসো।' এখানে 'বই-টই' কী?

3 / 18

'পথে পথে' কোন ধরনের শব্দ?

4 / 18

'ছোট ছোট জমি বিক্রি করে দাও।' এ বাক্যে দ্বিরুক্ত শব্দ কী অর্থ প্রকাশ করে?

5 / 18

ধ্বনিবাচক দ্বিরুক্ত শব্দ -

6 / 18

কোনটি ধ্বনাত্বক দ্বিরুক্তির উদাহরণ?

7 / 18

ডেকে ডেকে হয়রান হয়েছে এখানে ডেকে ডেকে দ্বিরুক্তিটি কোন অর্থে?

8 / 18

ধনাত্মক দ্বিরুক্তি শব্দের উদাহরণ কোনটি?

9 / 18

'ঝিরঝির করে বাতাস বইছে।' এখানে বিলুপ্তি শব্দটি কোন অর্থ প্রকাশ করেছে?

10 / 18

বিশেষণ পদ যোগে গঠিত দ্বিরুক্ত শব্দ কোনটি?

11 / 18

'ডাল-ভাত' কেমন অর্থের শব্দ যোগে দ্বিরুক্ত হয়েছে?

12 / 18

বিশেষ্য পদ যোগে গঠিত দ্বিরুক্ত শব্দ কোনটি?

13 / 18

'বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর' কোন ধরনের শব্দ?

14 / 18

'রাশি' শব্দের দ্বিরুক্তিতে কোন অর্থ প্রকাশ পায়?

15 / 18

'শিশুটি মা মা করে কাঁদছে।' এখানে 'মা মা' দ্বিরুক্তিটি কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে?

16 / 18

'কবি কবি ভাব কিন্তু ছন্দের অভাব।'- 'কবি কবি' কি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে?

17 / 18

ধনাত্মক দ্বিরুক্তি উদাহরণ কোনটি?

18 / 18

নিচের কোনটি যুগ্মরীতিতে দ্বিরুক্ত শব্দ?

Your score is

The average score is 68%

0%

Rate this quiz

বিসিএস প্রশ্ন বিশ্লেষণ

বিসিএস পরীক্ষায় ‘শব্দ (শব্দ, দ্বিরুক্ত শব্দ, লিঙ্গবাচক শব্দ, সংখ্যাবাচক শব্দ, বচন, সঠিক শব্দ নির্ণয় ইত্যাদি) থেকে ১-২ টি প্রশ্ন আসে। বিগত ৫ বিসিএসের পরিসংখ্যান –

৩৬৩৭৩৮৪০৪১

Leave a Reply