ধ্বনি ও বর্ণ

Estimated Reading Time: 51 Minutes

ধ্বনি

ধ্বনি ভাষার মূল উপাদান। মানুষের বাক প্রতঙ্গের সাহায্যে উচ্চারিত সকল আওয়াজই ধ্বনি। এক বা একাধিক ধ্বনির সমন্বয়ে গঠিত হয় শব্দ। ধ্বনির নিজস্ব কোন অর্থ নেই। সাধারণত কয়েকটি ধ্বনি মিলিত হয়ে অর্থের সৃষ্টি করে। বাক প্রত্যঙ্গজাত এসব ধ্বনির একটি সূক্ষ্মতম মৌলিক অংশ থাকে যাকে ধ্বনিমূল বলে। বাংলাভাষার ধ্বনিগুলোকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:-

  • স্বরধ্বনি: উচ্চারণের সময় মুখবিবরে বাতাস বাধা পায় না, স্বাধীনভাবে উচ্চারণ করা যায়।
  • ব্যঞ্জনধ্বনি: উচ্চারণের সময় মুখবিবরের কোথাও না কোথাও বাতাস বাধা পায়, স্বাধীনভাবে উচ্চারণ করা যায় না। ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণে আবশ্যিকভাবে স্বরধ্বনির আগমন ঘটে।

উল্লেখ্য প্রত্যেক ভাষাতেই কিছু মৌলিক ধ্বনি আছে। বাংলা ভাষায় মৌলিক ধ্বনি ৩৭টি (স্বরধ্বনি ৭টি ও ব্যঞ্জনধ্বনি ৩০ টি)।

স্বরধ্বনিকে আবার ২ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:

মৌলিক স্বর: এ ধ্বনিকে ভেঙে উচ্চারণ করা যায় না বা বিশ্লেষণ করা যায় না। মৌলিক স্বরধ্বনি ৭ টি। যথা: অ, আ, ই, উ, এ্যা, এ এবং ও। এগুলোকে পূর্ণ স্বরধ্বনিও বলে।

যৌগিক স্বর: দুটি স্বরধ্বনি একাক্ষর হিসেবে উচ্চারিত হলে তাকে যৌগিক স্বর বা দ্বিস্বর বা সন্ধিস্বর বলে। বাংলায় যৌগিক স্বরধ্বনির সংখ্যা ২৫ টি। যেমন: অ + এ = অয়, আ + এ = আয় ইত্যাদি।

উচ্চারণের ভিত্তিতে স্বরধ্বনিকে আবার নিম্নোক্তভাবেও ভাগ করা যায়-

পূর্ণস্বরধ্বনি: উচ্চারণের সময় পূর্ণভাবে উচ্চারিত স্বরধ্বনিগুলোই পূর্ণস্বরধ্বনি।

অর্ধস্বরধ্বনি: যে স্বরধ্বনিগুলো উচ্চারণের সময় পুরোপুরি উচ্চারিত হয় না তাদের অর্ধস্বরধ্বনি বলে। বাংলা ভাষায় অর্ধ স্বরধ্বনি ৪টি: [ই্], [উ্], [এ্] এবং [ও্]। উল্লেখ্য এ চারটি স্বরধ্বনিকে সবসময় অর্ধস্বরধ্বনি বলা হয় না। শুধুমাত্র যেসব ক্ষেত্রে এরা অর্ধরূপে উচ্চারিত হয় সেগুলো শব্দেই তাদের অর্ধস্বরধ্বনি বলা হয়। যেমন: লাউ = ল + আ + উ্; এ শব্দের আ পূর্ণস্বরধ্বনি এবং উ্ অর্ধস্বরধ্বনি। পূর্ণ স্বরধ্বনি উচ্চারণ করার সময়ে টেনে দীর্ঘ করা যায়, কিন্তু অর্ধস্বরধ্বনিকে কোনােভাবেই দীর্ঘ করা যায় না।

দ্বিস্বরধ্বনি: পূর্ণ স্বরধ্বনি ও অর্ধস্বরধ্বনি একত্রে উচ্চারিত হলে দ্বিস্বরধ্বনি হয়। যেমন: অয়, আয় ইত্যাদি। বাংলা বর্ণমালায় শুধুমাত্র দুটি দ্বিস্বরধ্বনির জন্য আলাদা বর্ণ নির্ধারিত আছে: (অ+ই) এবং (অ+উ)। ঐ-এর মধ্যে দুটি ধ্বনি আছে: পূর্ণ স্বরধ্বনি ‘অ’ (বা ‘ও’) এবং একটি অর্ধস্বরধ্বনি ‘ই’। একইভাবে ঔ = পূর্ণ স্বরধ্বনি ‘অ’ (বা ‘ও’) + অর্ধস্বরধ্বনি ‘উ’।

উচ্চারণের সময় জিভের উচ্চতা, জিভের সম্মুখ-পশ্চাৎ অবস্থান এবং ঠোঁটের উন্মুক্তি অনুযায়ী স্বরধ্বনিকে নিম্নোক্তভাবে ভাগ করা যায় –

জিভের উচ্চতা জিভ-সম্মুখ জিভ-মধ্য জিভ-পশ্চাৎঠোঁটের উন্মুক্তি
উচ্চসংবৃত 
উচ্চ-মধ্য
নিম্ন-মধ্য 
এ 
অ্যা 

অ 
অর্ধ-সংবৃত 
অর্ধ-বিবৃত 
নিম্ন বিবৃত 

ধ্বনি উচ্চারণের জন্য ব্যবহৃত প্রতঙ্গগুলো- ঠোঁট, দাতের পাটি, দন্তমূল, অগ্রদন্তমূল, অগ্রতালু, শক্ততালু, পশ্চাত্তালু, নরম তালু, মূর্ধা, আলজিভ, জিহবাগ্র, সম্মুখ জিহবা, পশ্চাদজিহবা, জিহবামূল, নাসা-গহ্বর, স্বর-পল্লব, স্বরতন্ত্রী, ফুসফুস।

স্পর্শধ্বনি

ক থেকে ম পর্যন্ত মোট ২৫ টি ধ্বনিকে স্পর্শধ্বনি বলা হয়।

অঘোষ
(অল্পপ্রাণ)
অঘোষ
(মহাপ্রাণ)
ঘোষ
(অল্পপ্রাণ)
ঘোষ
(মহাপ্রাণ)
ঘোষ
(অল্পপ্রাণ)
উচ্চারণ স্থান
কণ্ঠ্য (জিহ্বামূল)
শ, য, য়তালব্য (অগ্রতালু)
ষ, র, ড়, ঢ়মূর্ধণ্য (পশ্চাৎ দন্তমূল)
ল, সদন্ত্য (অগ্র দন্তমূল)
ওষ্ঠ্য (ঠোট)
বিভিন্ন প্রকার ধ্বনি

এখানে –

ঘোষ ধ্বনি: উচ্চারণের সময় স্বরতন্ত্রী অনুরণিত হয়।
অঘোষ ধ্বনি: উচ্চারণের সময় স্বরতন্ত্রী অনুরণিত হয় না।
অল্পপ্রাণ ধ্বনি: উচ্চারণে নিঃশ্বাস অল্প আকারে সংযোজিত হয়।
মহাপ্রাণ ধ্বনি: উচ্চারণে নিঃশ্বাস জোরে সংযোজিত হয়।

উপরোক্ত টেবিলে ক-ম পর্যন্ত ধ্বনিকে বর্গাকারে সাজানো হয়েছে। বর্গের প্রথম ও দ্বিতীয় ধ্বনিকে (১ম ও ২য় কলাম) অঘোষ ধ্বনি এবং তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম ধ্বনিকে ঘোষ ধ্বনি বলে। এছাড়া বর্গের ১ম, ৩য় ও ৫ম ধ্বনিকে অল্পপ্রাণ ধ্বনি এবং ২য় ও ৪র্থ ধ্বনিকে মহাপ্রাণ ধ্বনি বলে। আবার বর্গের ধ্বনিগুলোকে সারির প্রথম বর্ণের নাম অনুসারেও নামকরণ করা হয়। যেমন: প্রথম সারির ধ্বনিগুলোকে (ক, খ, গ, ঘ, ঙ) ক-বর্গীয় ধ্বনি বলা হয়। অনুরূপভাবে দ্বিতীয় সারির ধ্বনিগুলোকে (চ, ছ, জ, ঝ, ঞ) চ-বর্গীয় ধ্বনি, তৃতীয় সারিকে ট-বর্গীয়, চতুর্থ সারিকে ত-বর্গীয় এবং পঞ্চম সারিকে প-বর্গীয় ধ্বনি বলা হয়।

উল্লেখ্য উপরোক্ত ধ্বনিগুলো ছাড়াও (বর্গের বাইরে) অঘোষ অল্পপ্রাণ দ্যোতিত ধ্বনি ৩টি: শ, ষ, স এবং ঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনি ‘হ’।

আরও বিভিন্ন প্রকার ধ্বনি

  • উষ্মধ্বনি: এসব ধ্বনি উচ্চারণের সময় মুখবিবরের কোথাও বাঁধা না পেয়ে কেবল ঘর্ষণপ্রাপ্ত হয়। উষ্মধ্বনি ৩টি: শ, স, হ। তবে পুরাতন ব্যাকরণ বইয়ে ‘ষ’-কেউ উষ্মবর্ণ বলা হয়েছিল।
  • অন্তঃস্থ ধ্বনি: এসব ধ্বনির উচ্চারণ স্থান স্পর্শ ও উষ্মধ্বনির মাঝামাঝি। অন্তঃস্থ ধ্বনি ৪টি: ব, য, র, ল। এর মধ্যে আবার য তালব্য ধ্বনি, র কম্পনজাত ধ্বনি ও ল – কে পার্শ্বিক ধ্বনি বলা হয়।
  • নাসিক্য ধ্বনি: উচ্চারণের সময় নাক বা মুখ বা উভয় দিয়ে বাতাস বের হয়। নাসিক্য ধ্বনি ৫টি: ঙ, ঞ, ণ, ন, ম। মূলত বর্গের পঞ্চম ধ্বনিগুলোই নাসিক্য ধ্বনি। উল্লেখ্য ‘ ঁ’ পরবর্তী স্বরধ্বনির অনুনাসিকতার দ্যোতনা করে তাই একে অনুনাসিক ধ্বনি বলে।
  • তাড়নজাত ধ্বনি: উচ্চারণের সময় দ্যোতিত ধ্বনি জিহ্বার উল্টো পিঠের দ্বারা দন্তমূলে দ্রুত আঘাত বা তাড়না করে। তড়নজাত ধ্বনি ২টি: ড়, ঢ়
  • অযোগবাহ ধ্বনি: এসব ধ্বনির স্বর ও ব্যঞ্জনের সাথে কোন যোগ নেই। অযোগবহ ধ্বনি ২টি: (ং, ঃ)।
  • খণ্ড ব্যঞ্জণধ্বনি ১টি (ৎ)।
  • নিলীন ধ্বনি ১টি (অ)।
  • পরাশ্রায়ী বর্ণ ৩ টি ( ং, ঃ, ৺ )।

আরও তথ্য –

  • অঘোষ ‘হ’ ধ্বনির বর্ণরূপ ( ঃ)।
  • ‘ং’ এর উচ্চারণ ‘ঙ’ এর মতো।
  • এক প্রয়াসে উচ্চারিত ধ্বনি বা ধ্বনি সমষ্টিকে অক্ষর বলে।
  • অক্ষর উচ্চারণের কাল পরিমাণকে মাত্রা বলে।
  • পদের মধ্যে ‘ঃ’ থাকলে ব্যাঞ্জন দ্বিত্ব হয়। যেমন: দুঃখ(দুখ্খ)।

এক নজরে –

বর্ণ

ধ্বনি নির্দেশক চিহ্নকে বলা হয় বর্ণ। কোন ভাষায় ব্যবহৃত লিখিত বর্ণসমষ্টিকে সে ভাষার বর্ণমালা বলা হয়। যে বর্ণমালায় বাংলা বর্ণ লিখিত হয় তাকে বলা হয় বঙ্গলিপি। বাংলা বর্ণমালায় মোট বর্ণ ৫০টি

বর্ণ দুই প্রকার। যথা:-

  • স্বরবর্ণ
  • ব্যঞ্জনবর্ণ

স্বরবর্ণ: স্বরধ্বনি নির্দেশ করার জন্য ব্যবহৃত বর্ণ বা স্বরধ্বনির দ্যোতক লিখিত সাংকেতিক চিহ্নকে বলা হয় স্বরবর্ণ। বাংলা বর্ণমালায় স্বরবর্ণ ১১ টি: হ্রস্ব স্বর ৪টি (অ, ই, উ, ঋ), দীর্ঘ স্বর ৭টি (হ্রস্ব স্বর বাদে বাকিগুলো)।

  • স্বরবর্ণের সংক্ষিপ্ত রূপ হল ‘কার’। কার আছে এমন স্বরবর্ণ ১০টি (শুধুমাত্র “অ” এর সংক্ষিপ্ত রূপ নেই)।
  • মৌলিক স্বরজ্ঞাপক বর্ণ ৭টি: অ, আ, ই, উ, এ, ও, অ্যা।
  • যৌগিক স্বরজ্ঞাপক বর্ণ ২টি: ঐ = অ + ই, ঔ = অ + উ। অন্যান্য যৌগিক স্বরের কোন আলাদা বর্ণ নেই।

ব্যঞ্জনবর্ণ: ব্যঞ্জনধ্বনি দ্যোতক লিখিত সাংকেতিক চিহ্নকে বলা হয় ব্যঞ্জনবর্ণ।

  • বাংলা বর্ণমালায় ব্যঞ্জনবর্ণ ৩৯টি (প্রকৃত ৩৫টি + অপ্রকৃত ৪টি)
  • ব্যঞ্জনবর্ণের সংক্ষিপ্ত রূপ হল ‘ফলা’।
  • ফলা আছে এমন ব্যঞ্জণবর্ণ ৬টি: ম, ন, ব, য, র, ল ।

মাত্রা: বর্ণের উপরে যে রেখা ( ¯ ) বা দাগ দেওয়া থাকে তাই মাত্রা। মাত্রা অনুযায়ী বাংলা বর্ণ তিন ভাগে বিভক্ত। যথা:

  • পূর্ণমাত্রাযুক্ত বর্ণ: বর্ণের উপর পূর্ণ মাত্রা থাকে।
  • অর্ধমাত্রাযুক্ত বর্ণ: বর্ণের উপর অর্ধেক মাত্রা থাকে।
  • মাত্রাহীন বর্ণ: বর্ণের উপর কোন মাত্রা থাকে না।
মাত্রাস্বরবর্ণব্যঞ্জনবর্ণমোট
মাত্রাহীন৪টি (এ, ঐ, ও, ঔ)৬টি (ঙ, ঞ, ৎ, ং, ঃ, ঁ)১০টি
অর্ধমাত্রাযুক্ত১টি (ঋ)৭টি (খ, গ, ণ, থ, ধ, প, শ)৮টি
পূর্ণ মাত্রাযুক্ত৬টি (অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ)২৬টি৩২টি
মোট১১টি৩৯টি৫০টি

বাংলাভাষার কিছু ব্যঞ্জনবর্ণের নিজস্ব ধ্বনি নেই। এগুলো হল – ঞ, ণ, ক্ষ, ঢ়, য়, ষ, স, ৎ, ং, ঃ, ঁ।

কার ও ফলা

‘অ’ বাদে বাকি স্বরবর্ণগুলো ও কিছু কিছু ব্যঞ্জনবর্ণ দুটি ভিন্ন রূপে ভাষায় ব্যবহৃত হয়। এরা স্বাধীনভাবে শব্দের মাঝে ব্যবহৃত হয়; আবার অন্য কোন বর্ণের সাথে যুক্ত হয়ে সংক্ষিপ্ত রূপে বা আশ্রিত রূপেও ব্যবহৃত হয়। যেমন, ‘আ’ বর্ণটি ‘আবার’ শব্দ স্বাধীনভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং একইসাথে ‘ব’-র (ব + আ = বা) আশ্রিত হয়ে সংক্ষিপ্ত রূপেও (া ) ব্যবহৃত হয়েছে। ‘আ’-র এই সংক্ষিপ্ত রূপটিকে (া ) আ-কার বলা হয়। অনুরূপভাবে ই-কার(ি) , ঈ-কার(ী) , উ-কার(ু) , ঊ-কার(ূ) ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়।

বাংলা বর্ণমালায় ফলা ৬ টি। যথা: ণ/ন-ফলা, য-ফলা , ব-ফলা, ম-ফলা, র-ফলা ও ল-ফলা। যেমন: ‘চিহ্ন’ শব্দে ‘ন’ ফলা ব্যবহৃত হয়েছে। অনুরূপভাবে বিশ্বাস, তন্ময়, অত্যন্ত, গ্রহ, উল্লাস শব্দগুলোতে যথাক্রমে ব-ফলা, ম-ফলা, য-ফলা, র-ফলা ও ল-ফলা ব্যবহৃত হয়েছে।

যুক্তবর্ণ

গুরুত্বপূর্ণ যুক্তবর্ণগুরো নিম্নরূপ –

ক্র = ক্ + রক্ষ = ক্ + ষঙ্গ = ঙ্ + গজ্ঞ = জ্ +ঞ
ঞ্চ = ঞ্ + জত্র = ত্ + রত্থ = ত্ + থশ্রু = শ্ + র্ + উ
শ্রূ = শ্ + র্ + ঊষ্ণ = ষ্ + ণহৃ = হ্ + ঋহ্ন = হ্ + ন
হ্ম = হ্ + ম

ধ্বনি পরিবর্তন

ভাষার শব্দগুলো বহুজনে ব্যবহৃত হতে হতে কখনো কখনো সেই শব্দের ধ্বনিসমূহের মধ্যে কোনো কোনো ধ্বনি লোপ পায় কিংবা নতুন ধ্বনির আগমন ঘটে, কিন্তু শব্দটি দ্বারা পূর্বের অর্থই বোঝায়। ধ্বনির এরকম পরিবর্তনকে ধ্বনিপরিবর্তন বলে। যেমন: স্কুল>ইস্কুল; পিশাচ> পিচাশ ইত্যাদি। বিভিন্ন প্রকার ধ্বনি পরিবর্তন নিম্নরূপ –

আদি স্বরাগম (Prothesis): মূল শব্দের আদিতে স্বরধ্বনির আগমন ঘটলে তাকে আদি স্বরাগম বলে। যেমন:

  • স্কুল > স্কুল
  • স্পর্ধা > স্পর্ধা
  • স্তাবল > স্তাবল
  • স্টিমার > স্টিমার ইত্যাদি।

মধ্য স্বরাগম (Anaptyxis): মূল শব্দের মধ্যে স্বরধ্বনির আগমন ঘটলে তাকে মধ্য স্বরাগম বলে। যেমন:

  • রত্ন > রতন (র্+অ+ত+ন)
  • ধর্ম > ধরম
  • স্বপ্ন > স্বপন
  • ফিল্ম > ফিলিম
  • মুক্ত > মুকুতা
  • ভ্রু >ভুরু
  • গ্রাম > গেরাম
  • শ্লোক > শোলক
  • মুরগ > মুরোগ
  • ক্লি > কিলিপ ইত্যাদি।

অন্ত স্বরাগম (Apotheosis): মূল শব্দের শেষে স্বরধ্বনির আগমন ঘটলে তাকে অন্ত স্বরাগম বলে। যেমন:

  • সত্য>সত্যি
  • বেঞ্চ>বেঞ্চি
  • পোখত্ > পোক্ত
  • দিশ্> দিশা ইত্যাদি।

অপিনিহিতি (Apenthesis): শব্দমধ্যস্থ পরের ই বা উ ধ্বনি আগে উচ্চারণের প্রবণতাকে অপিনিহিত বলে। অর্থ্যাৎ শব্দে ই বা উ ধ্বনি থাকলে তাদের উচ্চারণ যথাস্থানের আগে করার প্রবণতাই অপিনিহিতি। যেমন:

  • আজি > আইজ
  • চারি > চাইর
  • রাখিয়া > রাইখ্যা
  • বাক্য > বাইক্য ইত্যাদি।

অসমীকরণ (Dissimilation): সমধ্বনি পাশাপাশি উচ্চারণের সময় অনেক ক্ষেত্রে মাঝখানে একটি স্বরধ্বনি যুক্ত হয়, তাকে অসমীকরণ বলে। একই ধ্বনির পুনরাবৃত্তি দুর করতে মাঝখানে স্বরধ্বনি যুক্ত হয়। যেমন:

  • ফট+ফট= ফটাফট
  • ধপ+ধপ=ধপাধপ
  • টপ+টপ=টপাটপ ইত্যাদি।

স্বরসঙ্গতি (Vowel Harmony): পরপর দুটি স্বরধ্বনি থাকলে উচ্চারণের সময় একটি পরিবর্তিত হয়ে অন্যটির মতো হওয়াকে স্বরসঙ্গতি বা উচ্চতাসাম্য বলে। যেমন: কবুল>কোবুল; বিলাতি>বিলিতি; মুলা>মুলো; বিদ্যা>বিদ্যে; দেশি>দিশি; তুলা>তুলো; মোজা>মুজো; জুতা>জুতো; ফিতা>ফিতে; নৌকা>নৌকো; পূজা>পূজো; সুতা>সুতো; শিয়াল>শেয়াল; ধুলা>ধুলো ইত্যাদি। একে আবার ৫ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:

  • প্রগত: আদিস্বর অনুযায়ী অন্ত্যস্বর পরিবর্তিত হলে। যেমন: মুলা>মুলো, তুলা>তুলো ইত্যাদি।
  • পরাগত: অন্ত্যস্বর অনুযায়ী আদিস্বর পরিবর্তিত হলে। যেমন: দেশি>দিশি।
  • মধ্যগত: আদিস্বর ও অন্ত্যস্বর অনুযায়ী মধ্যস্বর পরিবর্তিত হলে। যেমন: বিলাতি>বিলিতি
  • অন্যোন্য: আদিস্বর ও অন্ত্যস্বর দুটিই পরস্পর প্রভাবিত হলে। যেমন: মোজা>মুজো
  • চলিত বাংলা সরসঙ্গতি: মিঠা > মিঠে, চুলা > চুলো, ইচ্ছা>ইচ্ছে ইত্যাদি।
  • বিশেষ নিয়মে – এখনি > এখুনি।

ধ্বনিলোপ: উচ্চারণের সময় শব্দস্থিত কিছু ধ্বনি উচ্চারিত হয়না। এই প্রক্রিয়াকে ধ্বনিলোপ বলে। স্বরধ্বনি লুপ্ত হলে বা উচ্চারিত না হলে স্বরধ্বনিলোপ বা সম্প্রকর্ষ, ব্যঞ্জনধ্বনি লুপ্ত হলে ব্যঞ্জনধ্বনিলোপ বা ব্যঞ্জনচ্যুতি বলে। স্বরধ্বনির ক্ষেত্রে-

  • আদিস্বর লোপ: শব্দের আদি বা প্রথমে স্বরধ্বনিলোপ পেলে। যেমন: অলাবু>লাবু>লাউ; উদ্ধার>উধার>ধার ইত্যাদি।
  • মধ্যস্বর লোপ: শব্দের মধ্যে স্বরধ্বনি লোপ পেলে। যেমন: বসতি>বস্ তি; গামোছা>গাম্ ছা ইত্যাদি।
  • অন্ত্যস্বর লোপ: শব্দের অন্তে বা শেষে লোপ পেলে। যেমন: আজি (ই)>আজ; চারি (ই)>চার ইত্যাদি।

উল্লেখ্য স্বরাগম এবং স্বরালোপ সম্পর্কে পরস্পর বিপরীত। অনুরূপভাবে ব্যঞ্জনধ্বনির ক্ষেত্রে-

  • আদি ব্যঞ্জনলোপ: রংপুর>অংপুর; শ্রাবণ>শাবন
  • মধ্যব্যঞ্জনলোপ: মজদুর>মজুর; দুগ্ধ> দুধ
  • অন্তব্যঞ্জনলোপ: বৌদিদি>বৌদি; ছোটকাকা>ছোটকা; শিয়ালদহ>শিয়ালদ

ধ্বনি বিপর্যয়: উচ্চারণের সময় শব্দের দুটি ব্যঞ্জন পরস্পর স্থান পরিবর্তন করলে তাকে ধ্বনি বিপর্যয় বলে। যেমন:

  • নকশা > নশকা
  • কলমি > কমলি
  • পিশাচ > পিচাশ
  • রিক্সা > রিস্কা
  • লোকসান > লোসকান ইত্যাদি।

সমীভবন: উচ্চারণের সময় পাশাপাশি অবস্থিত দুটি ব্যঞ্জনধ্বনি একই রকম হয়ে যাওয়া কিংবা একই রকম হওয়ার প্রবনতাকে সমীভবন বলে। একে ব্যঞ্জনসঙ্গতিও বলা হয়। যেমন: দুর্গা>দুগ্গা; জন্ম>জম্ম ইত্যাদি।

বিসমীভবন: দুটো সমবর্ণের একটির পরিবর্তনকে বিষমীভবন বলে। যেমন:

  • শরীর > শরীল
  • লাল > নাল
  • জরুরি > জরুলি
  • লাঙ্গল > নাঙ্গল ইত্যাদি।

ব্যঞ্জন বিকৃতি: শব্দের মধ্যে কোন ব্যঞ্জনধ্বনি পরিবর্তিত হয়ে কোন নতুন ব্যঞ্জনধ্বনি ব্যবহৃত হয়, তাকে ব্যঞ্জন বিকৃতি বলে। যেমন:

  • কবাট>কপাট
  • ধোবা>ধোপা
  • ধাইমা>দাইমা
  • শাক>শাগ ইত্যাদি।

ব্যঞ্জনদ্বিত্বতা: জোর দেওয়ার জন্য শব্দের অন্তর্গত ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব উচ্চারণ হলে তাকে ব্যঞ্জনদ্বিত্বতা বলে। যেমন: পাকা > পাক্কা, সকাল > সক্কাল ইত্যাদি।

অন্তর্হতি: শব্দের মধ্যে কোন ব্যঞ্জনধ্বনি লোপ পেলে তাকে অন্তর্হতি বলে। যেমন: ফাল্গুন>ফাগুন, ফলাহার > ফলার, আলাদিয়া > আলাদা ইত্যাদি।

অভিশ্রুতি: অপিনিহিতি ও পরে বিপর্যয়ের ফলে পরিবর্তিত ধ্বনিতে যদি অপিনিহিতির প্রভাবজনিত ই কিংবা উ ধ্বনি পূর্বধ্বনির সঙ্গে মিলে শব্দের পরিবর্তন ঘটায় তাকে অভিশ্রুতি বলে। যেমন: (করিয়া>করিইয়া>কইরা>করে) করিয়া থেকে অপিনিহিতির ফলে করিইয়া হয়, তা থাকে বিপর্যয়ের ফলে কইরা হয় এবং শেষে অভিশ্রুতির ফলে করে শব্দ গঠিত হয়। অনুরূপভাবে, মানিয়া > মাইন্যা > মেনে; আজি > আইজ > আজ ইত্যাদি।

সমীকরণ: পর পর দুটি ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণ স্থান পৃথক হলে এবং এর মধ্যে একটির ধ্বনি বদলে গেলে, (যাতে ধ্বনি দুটির উচ্চারণ স্থান কাছাকাছি হয়) তাকে সমীকরণ বলে। যেমন: অনু+স্থান = অনুষ্ঠান।

র-কার লোপ: আধুনিক চলিত বাংলায় অনেক ক্ষেত্রে র-কার লোপ পায় এবং পরবর্তী ব্যঞ্জন দ্বিত্ব হয়। যেমন: তর্ক>তক্ক, করতে, কত্তে।

হ-কার লোপ: দুই স্বরের মাঝামাঝে হ-কারের লোপ হয়। যেমন: পুরোহিত>পুরুত, গাহিল>গাইল, শাহ্>শা ইত্যাদি।

ধ্বনি ও বর্ণ

বিগত সালের প্রশ্ন + অনুশীলনী

শুরু করার জন্য Next বাটনে ক্লিক করুন

আরও পোস্ট

  • কারক ও বিভক্তি
    Estimated Reading Time: 58 Minutes কারক বা কৃ (ক্রিয়া) + ণক (সম্পর্ক) একটি তৎসম শব্দ যার অর্থ “যা ক্রিয়া সম্পাদন করে”। বাক্যস্থিত ক্রিয়াপদের সাথে যে সম্পর্ক তাকে কারক বলে। যেমন: সকলকে মরতে হবে। কারক ৬ প্রকার। …

    কারক ও বিভক্তি Read More »

  • পুরুষ
    Estimated Reading Time: 4 Minutes ব্যক্তি বা বস্তু নির্দেশক সর্বনামকে পক্ষ বা পুরুষ বলে। বাক্যে পুরুষকে আশ্রয় করে ক্রিয়া সম্পাদিত হয়। পুরুষ তিন প্রকার। যথা: উত্তম পুরুষ: বক্তা নিজের নামের পরিবর্তে যে সর্বনাম ব্যবহার করে বা …

    পুরুষ Read More »

  • লিঙ্গ (পুরুষ ও স্ত্রী বাচক শব্দ)
    Estimated Reading Time: 10 Minutes লিঙ্গ শব্দের অর্থ চিহ্ন। পুরুষ, স্ত্রী, জড় পদার্থ ও উভয় সম্প্রদায়ভুক্ত জাতি বোঝাতে যে চিহ্ন ব্যবহার করা হয় তাকে লিঙ্গ বলে। সংস্কৃত ব্যাকরণের সাথে বাংলা ব্যাকরণের এক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। সংস্কৃত ব্যাকরণের …

    লিঙ্গ (পুরুষ ও স্ত্রী বাচক শব্দ) Read More »

  • পদাশ্রিত নির্দেশক
    Estimated Reading Time: 8 Minutes যেসব বা বাক্যস্থিত পদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নির্দিষ্টতা বা অনির্দিষ্টতা বোঝায়, সেগুলোকে পদাশ্রয়ী নির্দেশক বলে। যেমন: আজ বাংলা পড়ব, আমাকে ব্যাকরণ বই দাও; এখানে ‘বই’ শব্দ দ্বারা যেকোন ব্যাকরণ বই বোঝাচ্ছে, …

    পদাশ্রিত নির্দেশক Read More »

  • দ্বিরুক্ত শব্দ
    Estimated Reading Time: 23 Minutes দ্বিরুক্ত (= দ্বি+উক্ত) অর্থ দুইবার উক্ত হয়েছে এমন। বাংলা ভাষায় অনেক শব্দ, পদ বা শব্দ দুইবার ব্যবহৃত হয়ে একটি বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে। অর্থ্যাৎ শব্দটি একবার ব্যবহার করলে যে অর্থ প্রকাশ …

    দ্বিরুক্ত শব্দ Read More »

Category: বাংলা

Leave a Reply