বাক্যে ব্যবহৃত বিভক্তিযুক্ত শব্দ ও ধাতুকে পদ বলে। সাধারণ শব্দ যখন বাক্যে ব্যবহৃত হয়, তখন তার নাম হয় পদ। অর্থ্যাৎ বাক্যের প্রত্যেকটি শব্দই একেকটি পদ। পদে পরিণত হওয়ার জন্য শব্দের সঙ্গে যে শব্দাংশগুলো যুক্ত হয় তাদের লগ্নক বলে। গঠনগতভাবে পদ দুই প্রকার। যথা:
- সলগ্নক পদ: যেসব পদে লগ্নক থাকে সেগুলোকে সলগ্নক পদ বলে।
- অলগ্নক পদ: যেসব পদে লগ্নক থাকে না সেগুলোকে অলগ্নক পদ বলে।
উদাহরণ: “ছেলেরা ক্রিকেট খেলে” – এই বাক্যের ‘ছেলেরা’ (ছেলে + রা) ও ‘খেলে’ (খেল + এ) সলগ্নক পদ এবং ‘ক্রিকেট’ অলগ্নক পদ।
লগ্নক চার ধরনের। যথা:-
বিভক্তি: ক্রিয়ার কাল নির্দেশের জন্য এবং কারক বোঝাতে পদের সঙ্গে যেসব শব্দাংশ যুক্ত থাকে, সেগুলোকে বিভক্তি বলে। যেমন: ‘করলাম’ (শব্দমূল ‘কর’), ‘কৃষকের’ (শব্দমূল ‘কৃষক’) ইত্যাদি।
নির্দেশক: যেসব শব্দাংশ পদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পদকে নির্দিষ্ট করে, সেগুলোকে নির্দেশক বা পদাশ্রিত নির্দেশক বলে। “লোকটি” বা “ভালোটুকু” পদের ‘টি’ বা ‘টুকু’ হলো নির্দেশকের উদাহরণ।
বচন: যেসব শব্দাংশ পদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পদের সংখ্যা বোঝায়, সেগুলোকে বচন বলে। “ছেলেরা” বা “বইগুলো” পদের ‘রা’ বা ‘গুলো’ হলো বচনের উদাহরণ।
বলক: যেসব শব্দাংশ পদের সঙ্গে যুক্ত হলে বক্তব্য জোরালো হয়, সেগুলোকে বলক বলে। “তখনই” বা “এখনও” পদের ‘ই’ বা ‘ও’ হলো বলকের উদাহরণ।
বর্তমানে বাংলা ভাষায় পদ ৮ প্রকার। যথা: (বর্তমান ৯-১০ম শ্রেণীর বাংলা ব্যাকরণে ‘অব্যয়’ অন্তর্ভুক্ত নেই)
- বিশেষ্য
- বিশেষণ
- সর্বনাম
- ক্রিয়া
- ক্রিয়া বিশেষণ
- অনুসর্গ
- যোজক
- আবেগ
উল্লেখ্য শব্দ ও পদের মধ্যে মূল পার্থক্য হচ্ছে – “শব্দ হল ধ্বনির সমষ্টি এবং শব্দ বিভক্তিযুক্ত হয়ে বাক্যে ব্যবহৃত হলে তাকে বলা হয় পদ।” যেমন: ‘বাংলাদেশ’ একটি শব্দ। অপরদিকে “ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী”; এখানে ‘বাংলাদেশ’ শব্দের সাথে বিভক্তি (‘এর’) যুক্ত হয়ে বাক্যে ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে ‘বাংলাদেশের’ একটি পদ। তবে অনেকসময় বাক্যের পদগুলোতে বিভক্তি দেখা যায় না। সেক্ষেত্রে শূন্য বিভিক্তি যুক্ত হয়েছে বলে ধরা হয়। যেমন: বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। বিভক্তি যুক্ত না হলেও এক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশ’ একটি পদ হিসেবে গণ্য হবে। অর্থ্যাৎ সহজ ভাষায় বাক্যে ব্যবহৃত প্রত্যেকটি উপাদানই একেকটি পদ। উল্লেখ্য শব্দ শুধু রূপতত্ত্বে আলোচিত হয়, কিন্তু পদ একই সাথে রূপতত্ত্বে ও বাক্যতত্ত্বে আলোচিত হয়।
বিশেষ্য
যে শব্দ দিয়ে কোন কিছুর নাম বোঝায় তাই বিশেষ্য পদ। যেমন: করিম পরীক্ষায় ভাল ফল করেছে। এখানে করিম বিশেষ্য পদ।
বিশেষ্যের প্রকারভেদ
বিশেষ্য পদ সাধারণত ৬ প্রকার। যথা:
নাম বা সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য ব্যক্তি, স্থান ইত্যাদির নাম বোঝায়। যেমন: রহিম, ঢাকা, রবিবার, মেঘনা, হিমালয়, গীতাঞ্জলি ইত্যাদি। |
জাতিবাচক বিশেষ্য একই জাতীয় বস্তু বা প্রাণীর সাধারণ নাম বোঝায়। যেমন: কবি, মাছ, মানুষ, ইংরেজ, নদী, পর্বত, গাছ ইত্যাদি। |
বস্তুবাচক বিশেষ্য উপাদানবাচক পদার্থের নাম বোঝায়। যেমন: টেবিল, কাঠ, ধান, পানি, লবণ, মাটি, কলম ইত্যাদি। |
সমষ্টিবাচক বিশেষ্য বেশ কিছু বস্তু বা প্রাণীর সমষ্টিগত নামকে বোঝায়। যেমন: সেনাবাহিনী, দল, জনতা, সমিতি, মহফিল, বহর, সভা ইত্যাদি। |
গুণবাচক বিশেষ্য কোন কিছুর দোষ বা গুণের নাম বোঝায়। যেমন: দারিদ্র, দীনতা, সততা, ধৈর্য, গুরুত্ব, যৌবন, সৌরভ ইত্যাদি। |
ক্রিয়া-বিশেষ্য কোন কাজের নাম বোঝায়। যেমন: পঠন, শয়ন, গমন, দর্শন ইত্যাদি। |
বিশেষণ
যে পদ বিশেষ্য, সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের দোষ, গুণ, অবস্থা, পরিমাণ ইত্যাদি প্রকাশ করে তাকে বিশেষণ পদ বলে। যেমন: চলন্ত গাড়ি। এখানে চলন্ত গাড়ির একটি অবস্থা নির্দেশ করেছে, তাই এটি বিশেষণ পদ।
বিশেষণের প্রকারভেদ
বিশেষণ দুইভাগে বিভক্ত। যথা: নাম বিশেষণ ও ভাব বিশেষণ।
নাম বিশেষণ
যে বিশেষণ পদ কোনো বিশেষ্য বা সর্বনাম পদকে বিশেষায়িত করে তাই নাম বিশেষণ। যেমন: হাজার লোক। এখানে লোক বিশেষ্য পদ এবং হাজার শব্দ লোক শব্দটিকে বিশেষিত করেছে। নাম বিশেষণের প্রকারভেদ-
- রূপবাচক: নীল আকাশ, কালো মেঘ, সবুজ মাঠ
- গুণবাচক: চৌকশ লোক, দক্ষ কারিগর
- অবস্থাবাচক: তাজা মাছ, রোগা ছেলে
- সংখ্যাবাচক: শ টাকা
- ক্রমবাচক: দশম শ্রেনী
- পরিমাণবাচক: এক কেজি চাল
- অংশবাচক: সিঁকি পথ
- উপাদানবাচক: বেলে মাটি
- প্রশ্নবাচক: কতদূর পথ?
- নির্দিষ্টতাজ্ঞাপক: এই লোক, সেই ছেলে, ছাব্বিশে মার্চ
ভাববাচক বিশেষণ
যে বিশেষণ পদ বিশেষ্য ও সর্বনাম ব্যাতীত অন্য পদকে বিশেষায়িত করে তাকে ভাববাচক বিশেষণ বলে। যেমন: ধীরে ধীরে বায়ু বয়। ভাববাচক বিশেষণ ৪ প্রকার। যথা:
- ক্রিয়া বিশেষণ: ক্রিয়া সংঘটনের ভাব, কাল বা রূপ নির্দেশ করে। যেমন: পরে একবার আসবে।
- বিশেষণীয় বিশেষণ: বিশেষণ বা ক্রিয়া বিশেষণকে বিশেষিত করে। যেমন: রকেট অতি দ্রুত চলে।
- অব্যয়ের বিশেষণ: অব্যয়-পদ বা তার অর্থকে বিশেষিত করে। যেমন: ধিক্ তারে।
- বাক্যের বিশেষণ: সম্পূর্ণ বাক্যকে বিশেষিত করে। যেমন: বাস্তবিকই আজ আমাদের কঠিন পরিশ্রমের প্রয়োজন।
নাম বিশেষণ ও ভাব বিশেষণের মধ্যে পার্থক্য
নাম বিশেষণ শুধু বিশেষ্য বা সর্বনাম পদকে বিশেষায়িত করে। অপরদিকে ভাব বিশেষণ বিশেষ্য ও সর্বনাম ব্যাতীত অন্য পদকে বিশেষায়িত করে।
বিশেষণের অতিশায়ন
বিশেষণ পদ যখন দুই বা ততোধিক বিশেষ্য পদের মধ্যে গুণ, অবস্থা, পরিমাণ প্রভৃতি বিষয়ে তুলনায় একের উৎকর্ষ বা অপকর্ষ বুঝিয়ে থাকে, তখন তাকে বিশেষণের অতিশায়ন বলে। যেমন: যমুনা একটি দীর্ঘ নদী, পদ্মা দীর্ঘতর, কিন্তু মেঘনা দীর্ঘতম নদী।
বাংলা শব্দের অতিশায়ন
দুয়ের মধ্যে চাইতে, চেয়ে, হইতে, হতে, অপেক্ষা, থেকে ইত্যাদি শব্দ এবং বহুর মধ্যে সবচাইতে, সবচেয়ে, সব থেকে, সর্বাপেক্ষা, সর্বাধিক প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়। জোর দেওয়ার জন্য অনেক, অধিক, বেশি, কম ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। যেমন:
- গরুর থেকে ঘোড়ার দাম বেশি
- দশম শ্রেণীর ছাত্রদের মধ্যে করিম সবচেয়ে বুদ্ধিমান
- পদ্মফুল গোলাপের চাইতে অনেক সুন্দর।
তৎসম শব্দের অতিশায়ন
দুয়ের মধ্যে তর, তম, ঈয়স এবং বহুর মধ্যে তম, ইষ্ঠ প্রত্যয় যুক্ত হয়। যেমন-
- ঘোড়া হাতি অপেক্ষা অধিকতর সুশ্রী।
- নির্মান শেষ হলে পাদ্মা সেতু বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু হবে।
উল্লেখ্য একই পদ বিশেষ্য ও বিশেষণ উভয়রূপে প্রয়োগ হতে পারে। যেমন-
- ভালো বাড়ি পাওয়া কঠিন (বিশেষণ)
- আপন ভালো সবাই চায় (বিশেষ্য)
সর্বনাম
বিশেষ্যের পরিবর্তে বাক্যে যে পদ ব্যবহৃত হয় তাই সর্বনাম। যেমন: সে কাজটি করেছে। সর্বনামকে ৯ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
- ব্যক্তিবাচক বা পুরুষবাচক – আমি, তুমি, সে, আমরা, তোমরা, তারা, তাহারা, তিনি ইত্যাদি
- আত্মবাচক – নিজে, খোদ, স্বয়ং, আপনি
- নির্দেশক বা সামীপ্যবাচক – এ, এই, এরা, ইহারা, ইনি ইত্যাদি
- অনির্দিষ্ট – কেউ, কোন, কেহ, কিছু, কোথাও, কিছু, একজন ইত্যাদি।
- সকলবাচক – সবাই, সকল, সমুদয়, তাবৎ ইত্যাদি।
- প্রশ্নবাচক – কে, কি, কী, কোন ইত্যাদি
- সাপেক্ষ – যেমন-তেমন, যারা-তারা ইত্যাদি।
- পারস্পারিক বা ব্যতিহারিক – আপনা আপনি, নিজ নিজে, নিজেরা-নিজেরা, আপসে, পরস্পর ইত্যাদি
- অন্যবাচক – অন্য, অপর, পর ইত্যাদি
অব্যয় (পুরাতন ব্যাকরণ অনুযায়ী)
ক্রিয়া
যে পদ দ্বারা কোন কার্য সম্পাদন করা বুঝায় তাই ক্রিয়া পদ। যেমন: করিম বই পড়ছে। ক্রিয়ামূল বা ধাতুর সাথে পুরুষ অনুযায়ী কালসূচক ক্রিয়াবিভক্তি যুক্ত হয়ে ক্রিয়াপদ গঠিত। যেমন: পড়ছে = পড়্ (ধাতু) + ছে (বিভক্তি)। ক্রিয়াপদ বাক্যের অপরিহার্য অঙ্গ। ক্রিয়াপদ ছাড়া কোন বাক্য গঠিত হয় না। তবে কখনও কখনও ক্রিয়াপদ বাক্যে উহ্য বা অনুক্ত থাকতে পারে। যেমন: আজ প্রচণ্ড গরম = আজ প্রচণ্ড গরম (অনুভূত হচ্ছে)।
ক্রিয়ার প্রকারভেদ
ক্রিয়াপদকে বিভিন্নভাবে ভাগ করা যায়। ভাব প্রকাশের উপর ভিত্তি করে ক্রিয়াপদকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
- সমাপিকা ক্রিয়া: বক্তার মনোভাবের পরিসমাপ্তি জ্ঞাপিত হয়। যেমন: বন্যায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
- অসমাপিকা ক্রিয়া: বক্তার মনোভাবের পরিসমাপ্তি জ্ঞাপিত হয় না। যেমন: সকালে সূর্য উঠলে…। এ ধরণের ক্রিয়ার ক্ষেত্রে বাক্যটি সমাপ্ত হয়েছে কি না বোঝা যায় না।
একটি বাক্যে অসমাপিকা ক্রিয়া থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে। কিন্তু সমাপিকা ক্রিয়া থাকতেই হবে। সমাপিকা ক্রিয়া ছাড়া বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণ হয় না। যেমন: ‘এ কথা শুনে তিনি হাসলেন’ বাক্যটি সম্পূর্ণ, সুতরাং ‘হাসলেন’ – সমাপিকা ক্রিয়া। কিন্তু ‘এ কথা শুনে’—এই পর্যন্ত বাক্যটি বললে অর্থ অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তাই ‘শুনে’ ক্রিয়াপদটি অসমাপিকা। প্রথম বাক্যে ‘হাসলেন’ সমাপিকা ক্রিয়ার মাধ্যমে ‘শোনা’ ক্রিয়াটির অর্থ সম্পূর্ণতা পায়। আরও উদাহরণ: আমি বাড়ি এসে (অসমাপিকা) তোমাকে দেখলাম (সমাপিকা)। অনুরূপভাবে-
- চারটা বাজলে স্কুলের ছুটি হবে
- একবার মরলে কি কেউ ফেরে
- তিনি গেলে কাজ হবে
- এখন বৃষ্টি হলে ফসলের ক্ষতি হবে
- জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে?
- হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বস।
- এখন আমি যেতে চাই।
সাধারণ ভাবে ক্রিয়াপদ ৬ প্রকার। যথা:
- কর্মের উপর ভিত্তি করে-
- সকর্মক ক্রিয়া
- অকর্মক ক্রিয়া
- দ্বিকর্মক ক্রিয়া
- সমধাতুজ কর্মপদের ক্রিয়া
- প্রযোজক ক্রিয়া
- গঠন বৈশিষ্ট্য অণুসারে-
- যৌগিক ক্রিয়া
- মিশ্র ক্রিয়া
সকর্মক ক্রিয়া: বাক্যে কোন ক্রিয়াপদের কর্মপদ থাকলে তাকে সকর্মক ক্রিয়া বলে। যেমন: মা রান্না করছেন। এখানে ‘করছেন’ ক্রিয়াপদ এবং এর কর্ম হল ‘রান্না’। সুতরাং উক্ত বাক্যে ‘করছেন’ সকর্মক ক্রিয়া।
উল্লেখ্য বাক্যের ক্রিয়াপদকে কী?/কাকে? প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায়, তাই কর্ম পদ। যেমন: উপরিউক্ত বাক্যে ক্রিয়া ‘করছেন’ ; কী করছেন? প্রশ্ন করলে উত্তর পাওয়া যায় ‘রান্না’।
অকর্মক ক্রিয়া: বাক্যে কোন ক্রিয়ার কর্মপদ না থাকলে তাকে অকর্মক ক্রিয়া বলে। যেমন: করিম পড়ে। এখানে ‘পড়ে’ ক্রিয়াপদ, কিন্তু এর কোন কর্ম নেই। ‘পড়ে’- পদকে কী পড়ে? প্রশ্ন করলে কোন উত্তর উক্ত বাক্য থেকে পাওয়া যায় না। সুতরাং এখানে ‘পড়ে’ অকর্মক ক্রিয়া।
দ্বিকর্মক ক্রিয়া: বাক্যে যে ক্রিয়াপদের দুটি কর্মপদ থাকে তাকে দ্বিকর্মক ক্রিয়া বলে। যেমন: শিক্ষক ছাত্রদের বাংলা পড়াচ্ছেন। এখানে ক্রিয়াপদ ‘পড়াচ্ছেন’-কে কী পড়াচ্ছেন? প্রশ্ন করলে উত্তর আসে ‘বাংলা’, আবার কাকে পড়াচ্ছেন? প্রশ্ন করলে উত্তর আসে ‘ছাত্রদের’। সুতরাং উক্ত বাক্যে পড়াচ্ছেন ক্রিয়াপদের দুটি কর্ম আছে: ‘বাংলা’ ও ‘ছাত্রদের’।
সমধাতুজ কর্ম ও ক্রিয়া: বাক্যের ক্রিয়া ও কর্মপদ একই ধাতু দ্বারা গঠিত হলে ঐ কর্মপদকে সমধাতুজ কর্ম বা ধাত্বর্থক কর্মপদ বলে। যেমন: বেশ একটা ঘুম ঘুমিয়েছি। এখানে ‘ঘুমিয়েছি’ ক্রিয়াপদের কর্ম ‘ঘুম’, যারা একই ধাতু ‘ঘুম’ দ্বারা গঠিত। সুতরাং ‘ঘুম’ সমধাতুজ কর্ম এবং ‘ঘুমিয়েছি’ সমধাতুজ কর্মের ক্রিয়া।
প্রযোজক ক্রিয়া: যে ক্রিয়া একজনের প্রযোজনা বা চালনায় অন্য কর্তৃক অনুষ্টিত হয়, তাই প্রযোজক ক্রিয়া। যেমন: মা খোকাকে চাঁদ দেখাচ্ছেন। এখানে মায়ের প্রযোজনায় ‘খোকা’ ক্রিয়া সম্পন্ন করছে বা চাঁদ দেখছে।
যৌগিক ক্রিয়া: একটি সমাপিকা ও একটি অসমাপিকা ক্রিয়া যদি একত্রে একটি বিশেষ বা সম্প্রসারিত অর্থ প্রকাশ করে তবে তাই যৌগিক ক্রিয়া। যেমন: সাইরেন বেজে (অসমাপিকা) উঠল (সমাপিকা)।
মিশ্র ক্রিয়া: বিশেষ্য, বিশেষণ ও ধ্বনাত্বক অব্যয়ের সাথে ধাতুযোগে গঠিত ক্রিয়াপদ বিশেষ অর্থে মিশ্র ক্রিয়া গঠন করে। যেমন: আমরা তাজমহল দর্শন করলাম।
একনজরে
- বাবা আমাকে একটি কলম কিনে দিয়েছেন। কী কিনে দিয়েছেন – কলম (কর্মপদ), কাকে দিয়েছেন – আমাকে(কর্মপদ)। এ বাক্যে দুটি কর্মপদ আছে। (সকর্মক ক্রিয়া ও দ্বিকর্মক ক্রিয়া)
- মেয়েটি হাসে (অকর্মক ক্রিয়া)।
- মা শিশুকে চাঁদ দেখাচ্ছেন (প্রযোজক ক্রিয়া)। এখানে মা প্রযোজক (যে ক্রিয়া প্রযোজনা করে) এবং শিশু প্রযোজ্য (যাকে দিয়ে ক্রিয়া অনুষ্টিত হয়) কর্তা।
- ঘটনাটা শুনে রাখ (যৌগিক ক্রিয়া)।
- মাথা ঝিম ঝিম করছে (মিশ্র ক্রিয়া)।
সমাপিকা ক্রিয়া সকর্মক ও অকর্মক দুই-ই হতে পারে। যেমন: অনেক দিন ধরে ভাবছি লিখব (অকর্মক-সমাপিকা); কাল তোমাকে চিঠি লিখেছি (সকর্মক-সমাপিকা)।
ক্রিয়ার কাল ও ক্রিয়ার ভাব
আরও পড়ুন – ক্রিয়ার কাল ও ক্রিয়ার ভাব
ক্রিয়াবিশেষণ
যে পদ ক্রিয়াকে বিশেষায়িত করে তাকে ক্রিয়াবিশেষণ বলে। যেমন:
- ছেলেটি দ্রুত দৌড়ায়।
- লোকটি ধীরে হাটে।
ক্রিয়াবিশেষণকে কয়েকভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
ক্রিয়াবিশেষণ | কাজ | উদাহরণ |
---|---|---|
ধরনবাচক | কাজ কীভাবে সম্পন্ন হয় তা নির্দেশ করে | টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। ঠিকভাবে চললে কেউ কিছু বলবে না। |
কালবাচক | কাজ সম্পাদনের কাল নির্দেশ করে | আজকাল ফলের চেয়ে ফুলের দাম বেশি। যথাসময়ে সে হাজির হয়। |
স্থানবাচক | কাজের স্থান নির্দেশ করে | মিছিলটি সামনে এগিয়ে যায়। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। |
নেতিবাচক | ‘না’, ‘নি’ ইত্যাদি দিয়ে ক্রিয়াপদের নেতিবাচক অবস্থা বোঝায় | সে এখন যাবে না। তিনি বেড়াতে যাননি। এমন কথা আমার জানা নেই। |
পদাণু | বাক্যের মধ্যে বিশেষ কোনো ভূমিকা পালন না করলে ‘কি’, ‘যে’, ‘বা’, ‘না’, ‘তো’ প্রভৃতি পদাণু ক্রিয়াবিশেষণ হিসেবে কাজ করে। | আমি কি যাব? খুব যে বলেছিলেন আসবেন! কখনো বা দেখা হবে। একটু ঘুরে আসুন না, ভালো লাগবে। মরি তো মরবো। |
আবার গঠন বিবেচনায় ক্রিয়াবিশেষণকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
একপদী: একটি পদ নিয়ে গঠিত ক্রিয়াবিশেষণকে একপদী ক্রিয়াবিশেষণ বলে। যেমন: আছে, জোরে, চেঁচিয়ে, ভালোভাবে ইত্যাদি।
বহুপদী: একের অধিক পদ নিয়ে গঠিত ক্রিয়াবিশেষণকে বহুপদী ক্রিয়াবিশেষণ বলে। যেমন: ভয়ে ভয়ে, চুপি চুপি ইত্যাদি।
যোজক
পদ, বর্গ বা বাক্যকে যেসব শব্দ যুক্ত করে তাদের যোজক বলে। যেমন: এবং, ও ইত্যাদি। অর্থ ও সংযোজনের বৈশিষ্ট্য অনুসারে যোজক শব্দকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন:
সাধারণ যোজক: দুটি শব্দ বা বাক্যকে জুড়ে দেয়। যেমন: আর, এবং, ও, বা, কিংবা, তথা ইত্যাদি।
- সুখ ও সমৃদ্ধি কে না চায়? (দুটি শব্দের সংযোগক)
- কবির আর রহিম একে অন্যের বন্ধু। (দুটি শব্দের সংযোগক)
- আমাদের সমাজব্যবস্থা আর ওদের সমাজব্যবস্থা এক রকম নয়। (দুটি বাক্যকল্পের সংযোগ)
- জলদি দোকানে যাও এবং একটা পাউরুটি কিনে আনো। (দুটি বাক্যের সংযোগ)
বিকল্প যোজক: একাধিক শব্দ বা বাক্যকল্প বা বাক্যের বিকল্প নির্দেশ করে। যেমন:
- মৌসুমী হয় ট্রেনে, না হয় বাসে যাবে।
- সারা দিন খুঁজলাম, অথচ কোথাও গরুটা পেলাম না।
বিরোধমূলক যোজক: দুটি বাক্যের সংযোগ ঘটিয়ে দ্বিতীয়টির সাহায্যে প্রথম বাক্যের বক্তব্যের সংশোধন বা বিরোধ নির্দেশ করে। যেমন:
- এত বৃষ্টি হলো, তবু গরম গেল না।
- তোমাকে খবর দিয়েছি, কিন্তু তুমি আসোনি।
কারণবাচক যোজক: দুটি বাক্য, যার একটি অন্যটির কারণ নির্দেশ করে, তাদের মধ্যে সংযোগ ঘটায়। যেমন:
- জিনিসের দাম বেড়েছে, কারণ হরতাল-অবরোধ চলছে।
- খুব ঠাণ্ডা লেগেছে, তাই আইসক্রিম খাচ্ছি না।
সাপেক্ষ যোজক: একে অন্যের পরিপূরক হয়ে বাক্যে ব্যবহৃত হয়। প্রথাগত ব্যাকরণে এগুলোকে বলে নিত্যসম্বন্ধীয় অব্যয়। যেমন:
- যত গর্জে তত বর্ষে না।
- যথা ধর্ম তথা জয়।
আবেগ বা আবেগসূচক পদ
যেসব পদ বা শব্দাংশ দিয়ে মনের নানা ভাব বা আবেগকে প্রকাশ করা হয় তাই আবেগসূচক পদ। এ পদগুলো বাক্যের অন্য শব্দের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত না হয়ে স্বতন্ত্রভাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন: হাহা, হায় হায়, সাবাশ ইত্যাদি। আবেগসূচক পদের পর আবেগসূচক চিহ্ন (!) বসে। বিভিন্ন প্রকার আবেগ –
সিদ্ধান্তবাচক আবেগ: অনুমোদন, সম্মতি, সমর্থন ভাব প্রকাশ করা হয়। যেমন: হ্যাঁ, আমাদের জিততেই হবে।
বেশ, তবে যাওয়াই যাক।
প্রশংসাবাচক আবেগ: প্রশংসাবাচক মনোভাব প্রকাশ করা হয়। যেমন: শাবাশ! এমন খেলাই তো চেয়েছিলাম! বাহ্! চমৎকার লিখেছ।
বিরক্তিসূচক আবেগ: অবজ্ঞা, ঘৃণা, বিরক্তি মনোভাব প্রকাশে ব্যবহৃত হয়। যেমন: ছি ছি! এরকম কথা তাঁর মুখে মানায় না। জ্বালা! তোমাকে নিয়ে আর পারি না!
আতঙ্কসূচক আবেগ: আতঙ্ক, যন্ত্রণা, কাতরতা প্রকাশ করে। যেমন: উহ্, কী বিপদে পড়া গেল। বাপরে বাপ! কী ভয়ঙ্কর ছিল রাক্ষসটা।
বিস্ময়সূচক আবেগ: বিস্মিত বা আশ্চর্য হওয়ার ভাব প্রকাশ করে। যেমন: আরে! তুমি আবার কখন এলে? আহ্, কী চমৎকার দৃশ্য!
করুণাসূচক আবেগ: করুণা, মায়া, সহানুভূতির মনোভাব প্রকাশ করে। যেমন: আহা! বেচারার এত কষ্ট। হায় হায়! ওর এখন কী হবে!
সম্বোধনসূচক আবেগ: সম্বোধন বা আহ্বান করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। যেমন: হে বন্ধু, তোমাকে অভিনন্দন। ওগো, তোরা জয়ধ্বনি কর।
আলংকারিক আবেগ: কোমলতা, মাধুর্যের মতো বৈশিষ্ট্য এবং সংশয়, অনুরোধ, মিনতির মনোভাব প্রকাশের জন্যে অলংকার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন: দূর! এ কথা কি বলতে আছে? যাকগে, ওসব কথা থাক।