প্রদোষে প্রাকৃতজন

Estimated Reading Time: 9 Minutes

সেন বংশের বৃদ্ধ রাজা লক্ষ্মণ সেন বাংলার ক্ষমতায়; লক্ষ্মণাবতী বাংলার রাজধানী। সামন্তদের উপর রাজা লক্ষ্মণ সেনের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ফলে রাজ্যের কলকাঠি ছিল সামন্তরাজাদের হাতে। নিজেদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ রাখতে সামন্তরাজারা সাধারণ মানুষের উপর বর্ণনাতীত নির্যাতন চালাত। সামন্তদের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিম্নবর্গের মানুষেরা মাঝে মাঝে বিদ্রোহী হয়ে উঠলে সামন্তপতিরা বিদ্রোহী জনগণের উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিত। হরিসেন এমনসব সামন্তরাজাদের একজন। এমন সময় বাংলায় শুরু হয় যবন তথা মুসলমানদের আনাগোনা। সমগ্র উত্তর ভারত পেরিয়ে মুসলমানদের লক্ষ্য এখন বাংলার দিকে।

উপন্যাসের প্রধান চরিত্র শ্যামাঙ্গ,লীলাবতি, বসন্তদাস, মায়াবতী প্রমূখ। মায়াবতী শুকদেবের কন্যা, বসন্তদাসের স্ত্রী। স্বামী বাণিজ্যে যাওয়ায় সে পিত্রালয়ে থাকে। অপরদিকে লীলাবতীর স্বামী অভিমন্যু দাস এক বদ্ধ উন্মাদভ। তার নিজের এবং অপরের প্রতি কোন বিশ্বাস নেই। মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গ দেবীপীঠে ব্রাত্যমূর্তি নির্মাণ করায় গুরু বসুদেবের গৃহ থেকে বিতাড়িত হয়। সে উজুবটে শুকদেবের বাড়িতে আশ্রয় পায়। মায়াবতী ও লীলাবতীর সাক্ষাৎসূত্রে শ্যামাঙ্গ লীলাবতীর সঙ্গে প্রণয়াসক্ত হয়ে পড়ে।

একসময় মায়াবতীর অনুরোধক্রমে বসন্তদাসকে খুজতে শ্যামাঙ্গ নবগ্রাম হাটে উপনীত হয়। সেখানে সামন্তরাজা হরিসনের সৈন্যের হাতে সে তার সর্বস্ব হারায়। কুসুম্বী গ্রামে এক কুম্ভকারের ঘরে শ্যামাঙ্গ আশ্রয় পায়। এদিকে উজুবটে বসন্তদাস ফিরে আসে। সে সামন্তরাজা হরিসনের শোষণ থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে সেনদের দ্বারা বিতারিত বৌদ্ধভিক্ষুদের সরদার মিত্রানন্দের সন্ধান করতে থাকে।

যবনদের আক্রমণ এবং প্রজাপীড়নের ঘটনা জনৈক যোগীর কাছে শ্যামাঙ্গ জানতে পারে। সে পুনরায় শুকদেবের বাড়িতে এসে হাজির হয়। হরিসনের সৈন্যরা শুকদেব ও লীলাবতীদের বাড়ি জ্বালিয়ে দিলে প্রাণ রক্ষার্থে শ্যামাঙ্গ লীলাবতীকে নিয়ে আত্মগোপনের চেষ্টা করে।

এদিকে বসন্তদাস মিত্রানন্দকে খুজতে খুজতে ছায়াবতীর মন্দিরে গিয়ে হাজির হয় এবং মিত্রানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তার সাথে মিত্রতার চেষ্টা করে। কিন্তু বসন্তদাস ব্যর্থ হয় এবং আসন্ন সন্তানের আগমনে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করে। ওদিকে শ্যামাঙ্গ ও লীলাবতী শিলনাথের বাড়ি থেকে মাতুল সিদ্ধপার আদেশে পলায়নকালে যবন হাতে পরে যায়। লীলাবতী প্রাণ রক্ষার্থে যবন ধর্ম গ্রহণ করলেও শ্যামাঙ্গ যবন ধর্ম গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। অবশেষে শ্যামাঙ্গ সামন্ত হরিসনের সৈন্য অভিমন্যু দাসের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়।

উপন্যাসের সোমজিত নামক চরিত্রটি তৎকালীন সমাজিক সংহতি রক্ষায় তৎপর হয়ে উঠে। সে সামন্তদের অত্যাচারের পীড়ন থেকে মুক্তি পেতে লক্ষণ সেনের দরবারে ছুটে যায়। কিন্তু সামন্তবেষ্টিত রাজদরবারে রাজার কাছে ঘেঁষার সুযোগ সোমজিতের হয়ে উঠত না। এসময় হলায়ুধ মিশ্রের মত লক্ষ্মণ সেনের পণ্ডিতাম্মন্য প্রভাবশালী মন্ত্রীর মধ্যেও একধরনের অবসন্ন শীতলতা দেখা যায়। যবনদের আগমন নিয়ে সোমজিতের উদ্বেগের বিপরীতে হলায়ুধ বলেন,

“যবনদের আগমনে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েই বা কী হবে- যা ভবিতব্য তাই হবে। এও কর্মফল বলতে পারো। আমার বিশ্বাস, যবনদের আগমনে ধর্ম বলো, জাতি বলো, কোনোকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তারা যদি এ দেশ জয় করে নেয়, তাহলে নিশ্চয় তাদের এদেশ শাসন করতে হবে।”

একসময় মুসলমানরা রাজধানী লক্ষ্মণাবতী আক্রমণ করে। রাজা লক্ষণ সেন কোনো প্রতিরোধ সৃষ্টি না করেই পালিয়ে যান। ফলে তুর্কি মুসলিমরা একটি রাজশক্তি হিসেবে বাংলায় আত্মপ্রকাশ করে।

উপন্যাস, শওকত আলী

Leave a Reply