বিশ্বায়ন

Estimated Reading Time: 22 Minutes

বিশ্বায়ন হল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক সম্পর্ক পরিবর্ধনের মাধ্যমে স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতিকে একটি একক বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একীভূতকরণের প্রক্রিয়া। বিশ্বায়ণকে নানাভাবে সংঙ্গায়িত করা গেলেও সহজ ভাষায় বিশ্বায়নের অর্থ হল একক বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। এটি বাণিজ্যকে বাধাহীনভাবে বিশ্বব্যাপী পরিচালনা করার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতিমালা বা প্রক্রিয়া। গত শতকে পরিবহন ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতির ফলাফল হচ্ছে বিশ্বায়ন।

বিশ্বায়নের ফলে সাড়া বিশ্বে পণ্য ও পুজির অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত হয়েছে। আবার সাড়া বিশ্বকে এক কেন্দ্র থেকে শাসন করার নতুন অথনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কৌশল হিসেবে বিশ্বায়নের ব্যাপক সমালোচনাও রয়েছে। দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ধনী রাষ্ট্রগুলোর অথনৈতিক ধারণা হিসেবে বিশ্বায়ণকে উপনিবেশের নব্যরূপও বলা হয়ে থাকে।

ইতিহাস

বিশ্বায়ণের ধারণাটি অনেক পুরাতন। মূলত উপনিবেশিক যুগ থেকে বিশ্বায়নের প্রাথমিক যুগের সূচনা। এ সময় ইউরোপের দেশগুলো উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকায় তাদের উপনিবেশ স্থাপন করে। ফলে বাণিজ্যের বিকাশ ঘটে ও অবাধ বাণিজ্যের ধারণা সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশের ফলে নতুন নতুন ব্যবসার সৃষ্টি হয় এবং পুজিবাদের ধারণার উদ্ভাবন হয়। ফলে ভূমি দখলের চেয়ে ব্যক্তিগত সম্পদ ও অর্থ বৃদ্ধির ধারণা আসে। এতে বিশ্বায়নের ধারণাটি পরবর্তী স্তরে পৌছে যায় এবং আধুনিক বিশ্বায়নের ভিক্তি তৈরি করে। বিশ্বায়ন ধারণাটি প্রতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। উন্নত বিশ্বের পুজিপতিরা তাদের পুজির বিস্তারের জন্য বিশ্বায়নকে প্রতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। তাদের উৎপাদিত পণ্যগুলো বিক্রি করার জন্য অবাধ যোগাযোগসহ অন্যান্য স্বাধীনতার প্রয়োজন ছিল। এসব প্রয়োজন পূরণ করতে পুজিবাদীরাই বিশ্বায়নের ধারনাকে সামনে নিয়ে আসে। ব্রেটন উডস সম্মেলনের মাধ্যমে ধারণাটি বাস্তবরূপ লাভ করে। এ সম্মেলনে বিশ্ব বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও ডব্লিডওটিওর মত সংস্থা গড়ে তোলা হয়। যা বিশ্বায়নের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানেরই নামান্তর।

বিশ্বায়নের ফলে পুজিবাদীরা তাদের পুজি বৃদ্ধি করার সুযোগ পেয়েছে। বিশ্বায়ন দিয়ে তারা নব্য উপনিবেশ তৈরি করতে পেরেছে। বিশ্বায়নের নাম দিয়ে পুজিবাদীরা বিশ্ব রাজনীতি, অথনীতি ও সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা বৈধতা পেয়েছে। সামরিক শক্তিকে ব্যবহার না করে বিশ্বায়নকে ব্যবহার করে এখন সাড়া বিশ্বকে এককেন্দ্র থেকে শাসন করা হচ্ছে। আর এসব উদ্দেশ্য থেকে পুজিবাদীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বিশ্বায়ন আসে।

বিশ্বায়নের প্রভাব

প্রাথমিকভাবে বিশ্বায়ন একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া হলেও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। শুরুতে গরীব দেশগুলো বেশি লাভবান হবে বলা হলেও মূলত বিশ্বায়নকে কেন্দ্র করে বেশি লাভবান হয়েছে পুজিবাদী ধনী দেশগুলোই। নিম্নে বিশ্বায়নের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো আলোচনা করা হলো –

ইতিবাচক দিক:

  • দরিদ্র দেশগুলো বিদেশী বিনিয়োগ পাওয়ায় তাদের উৎসক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে তারা কিছুটা লাভবান হয়েছে।
  • মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার সৃষ্টি করেছে। ফলে উৎপাদিত পণ্যগুলো বিশ্ববাজারে ভাল মূল্য পাওয়ায় সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবন উৎসাহিত হচ্ছে।
  • জ্ঞান বিনিময়ের অবাধ সুযোগ থাকায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও বিনিময় সহজ হয়েছে।
  • উন্নয়নশীল দেশগুলো আধুনিক প্রযুক্তির উপকারিতা ভোগ করতে পারছে।
  • সংস্কৃতি বিনিময়ের ফলে বৈশ্বিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পাওয়া সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

নেতিবাচক দিক:

  • দেশীয় ক্ষুদ্র শিল্পগুলো নিজ বাজারে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে তীব্র প্রতিযোগীতার মুখোমুখি হচ্ছে। এতে দেশীয় শিল্পগুলো মারাত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
  • উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত বিশ্বের ওপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় দরিদ্র দেশগুলোর সার্বভৌমত্ব ঝুকির মুখে পড়েছে। উন্নয়ন সাহায্যের নামে তাদের পরনির্ভরশীল করে তোলা হচ্ছে। ফলে একটি নব্য ঔপনিবেসিক ব্যবস্থার উদ্ভব হচ্ছে।
  • ভিনদেশী সংস্কৃতির প্রভাবে দেশীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নষ্ট হচ্ছে। অপসংস্কৃতির প্রভাবে সমাজে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
  • নানা কৌশলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পুজি উন্নত দেশে পাচার হওয়ার আখেরে উন্নত বিশ্বই বিশ্বয়ন প্রক্রিয়া থেকে বেশি লাভবান হচ্ছে।

বিশ্বায়নের ফলাফল

বিশ্বায়ন পুরে পৃথিবীকে একটি একক গ্রামে পরিণত করেছে। এখন মুহুর্তের মধ্যে পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের খবর জানা যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতির ফলে বিশ্বের যেকোন প্রান্তে যাওয়া এখন আর সময়সাপেক্ষ ব্যাপার নয়। এছাড়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসর, বৈশ্বিক সংস্কৃতি বিনিময়সহ বেশ কিছু বিষয়ে বিশ্বায়নে সুফল পাচ্ছে বিশ্ববাসী। তবে বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও বিশ্বায়ন উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এখনও আশীর্বাদ স্বরূপ হয়ে উঠতে পারে নি। বরং বিশ্বায়নের নামে ভোগবাদ বিকশিত হয়েছে। যেমন মৌলিক শিক্ষা-চাহিদা পূরণের জন্য বিশ্বব্যাপী যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন কেবল আমেরিকাতেই সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় প্রসাধন সামগ্রীর পেছনে। বিশ্বব্যাপী সামরিক খাতে ব্যয়ের মাত্র এক শতাংশ অর্থ দিয়ে পৃথিবীর প্রত্যেক শিশুকে শিক্ষার আওতায় আনা সম্ভব। কিন্তু বিশ্বায়ন তা করতে ব্যার্থ হয়েছে। বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বব্যাপী বৈষম্য বাড়ছে, সাথে সাথে বাড়ছে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য। এছাড়া দ্রুত বিশ্বায়নের ফলে পরিবেশ ধংস্ব হচ্ছে, সমাজে বিভেদ হানাহানি বাড়ছে, বিশ্বব্যাপী সামাজিক, রাজনৈতিক ও অথনৈতিক সমস্যা বেড়ে চলছে।

বিশ্বায়ন ও বাংলাদেশ

১৯৯২ সালে বাংলাদেশ মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করার মাধ্যমে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বব্যবস্থার যে বিস্ময়কর বিকাশ ঘটেছে তার ছোঁয়া বাংলাদেশেও এসে লেগেছে। তবে বাজার উন্মুক্ত করার কারণে শুরুতে দেশীয় শিল্পগুলােকে কঠিন প্রতিযােগিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। অসম প্রতিযোগিতার ফলে অনেক দেশীয় শিল্প বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশ তখন শুল্ক ব্যবস্থা সমন্নয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করেছে। ২০০০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে FDI (Foreign Direct Investment) ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে যা বাংলা অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস তৈরি পোশাক শিল্প বিশ্বায়নের ফলে একই সাথে ব্যাপক সুযোগ ও প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়েছে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পণ্যের কোটা সুবিধা তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, কৃষিজ পণ্য প্রভৃতি রপ্তানি পণ্যের বিকাশে সাহায্য করেছে। তবে ভবিষ্যতে কোটা সুবিধা না থাকলে এসব প্রণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারের তীব্র প্রতিযােগিতায় টিকে থাকা কষ্টসাধ্য হতে পারে। বিপরীতে উন্নত দেশের দ্রব্যসামগ্রী বাংলাদেশের বাজারকে দখল করে নিয়েছে। ফলে দেশীয় পণ্যের বাজার তার অবস্থান হারিয়েছে। যেমন প্লাস্টিকের আগমনে প্রায় বিলুপ্তির পথে দেশীয় কুটির শিল্প। বিশ্বায়নের ফলে যে অবাধ বাণিজ্যের সুযােগ সৃষ্টি হয়েছে তা ক্রমশই অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মত বাংলাদেশকেও উন্নত বিশ্বের পণ্যের বাজারে পরিণত করছে। বিশ্বায়নের সংস্কৃতিক প্রভাবে বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতিও নিজের অবস্থান হারাতে বসেছে। এছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বিভেদ আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সামাজিক বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে।

বিশ্বায়নের স্রোতে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশকে দ্রুত ভৌত কাঠামাের উন্নয়নে মনযোগী হতে হবে। বাংলাদেশকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তাসহ সামাজিক ও অর্থনীতিক ক্ষেত্রসমূহে বিনিয়ােগ বৃদ্ধি, প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে ব্যাপকভাবে গবেষণা ছাড়াও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক আত্মনিয়ােগ। অস্থিতিশীল সামাজিক ও রাজনীতিক পরিবেশকে নির্মূল করে সংযত ও সহনশীল তথা স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারে।

উপসংহার

আধুনিক বিশ্বে বিশ্বায়ন থেকে পালিয়ে বাঁচার কোনো উপায় নেই। এখান প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিশ্বায়ন ব্যবস্থাপনার কোন উপায় বিশ্বনেতৃত্ব বেছে নেবে। বিশ্বায়ন সীমানা অতিক্রম করে জিনিসপত্র, সেবা, পুঁজি থেকে তথ্য, সন্ত্রাসবাদ এবং রোগব্যাধি, যা-ই হোক না কেন, সবকিছুর বিপুল ও দ্রুত প্রবাহ নিশ্চত করেছে। অর্থ্যাৎ এটি একই সাথে ভালো মন্দ উভয় দিকই নিয়ে এসেছে। কিন্তু বিশ্বায়নের সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য বৈশ্বিক প্রচেষ্টা যে কতটা অপর্যাপ্ত ও হতাশাজনক তা সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ ও বৈশ্বিক উষ্মতা বৃদ্ধির হতাষাজনক ব্যাবস্থাপনা থেকে আঁচ করা যায়। সুতরাং বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপযুক্ত ব্যবহার ও বিশ্বায়নের সমস্যাগুলোর সময়োপযোগী সমাধানই পারে বিশ্বায়নকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে।

তথ্যসূত্র:

Leave a Reply