ভাষা ও ব্যাকরণ

Estimated Reading Time: 38 Minutes

ভাষা

মানুষের ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। দেশ, কাল ও পরিবেশভেদে ভাষার পার্থক্য ও পরিবর্তন ঘটে থাকে। বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ৩৫০০ ভাষা প্রচলিত রয়েছে।

মুখে উচ্চারিত অর্থবোধক মনোভাব প্রকাশক ধ্বনিসমষ্টিকে ভাষা বলে।

প্রত্যেক ভাষার ৪টি (মতান্তরে ৩টি) মৌলিক অংশ থাকে। যথা: ধ্বনি, শব্দ, অর্থ ও বাক্য। 

ভাষার মূল উপাদান ধ্বনি। বাকযন্ত্রের সাহায্য ধ্বনির সৃষ্টি হয়। কিন্তু ভাষার মৌলিক উপাদান হচ্ছে শব্দ। কারণ ভাষার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থবাচকতা প্রকাশ করা। ধ্বনিগুলো অর্থ প্রকাশ নাও করতে পারে (যেমন- শিশুর মুখের ধ্বনি); কিন্তু শব্দের সাথে অর্থের সংশ্লিষ্টতা দেখা যায়। আবার একাধিক শব্দের উপযুক্ত সমন্নয়ে বাক্য গঠিত হয়। একটি সম্পূর্ণ বাক্যই ভাষার প্রাণ। বাক্যকে ভাষার মূল উপকরণ বলা হয়।

ভাষার মূল উপাদান / ভাষার বাহন বা স্বর বা ক্ষুদ্রতম এককধ্বনি
শব্দের মূল উপাদান / মূল উপকরণ / ক্ষুদ্রতম এককধ্বনি
ভাষার মূল উপকরণ / ভাষার ছাদ / ভাষার বৃহত্তম এককবাক্য
বাক্যের মূল উপাদান / উপকরণ বা মৌলিক উপাদান / উপকরণ বা মূল একক / ক্ষুদ্রতম এককশব্দ
শব্দের গঠনগত একক / ভাষার ইটবর্ণ
বাক প্রতঙ্গজাত ধ্বনির ক্ষুদ্রতম একক বা মৌলিক অংশধ্বনিমূল

ভাষা পরিবার

ভাষা পরিবার বলতে বংশগতভাবে সম্পর্কিত একাধিক ভাষাকে বোঝায়। একই পরিবারভুক্ত ভাষাগুলো একটি সাধারণ আদিভাষা থেকে উদ্ভুত হয়েছে বলে মনে করা হয়। পৃথিবীতে ১০০টিরও বেশি ভাষা পরিবার আছে। উপমহাদেশের ভাষাগুলোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য দুটি ভাষা পরিবার হল: ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারদ্রাবিড় ভাষা পরিবার

ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্গত ভাষাগুলো হল: ইংরেজী, উর্দু, সিন্ধি, হিন্দি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, মারাঠি, বাংলা, ওড়িয়া, অসমিয়া, ভোজপুরি ইত্যাদি।

দ্রাবিড় ভাষা পরিবারের অন্তর্গত ভাষাগুলো হল: তামিল, তেলেগু, কন্নড় ও মালয়ালয়।

বাংলা ভাষা

বাংলা ভাষা একটি ইন্দো-আর্য ভাষা। এটি দক্ষিণ এশিয়ার বাঙালি জাতির প্রধান কথ্য ও লেখ্য ভাষা। মোট ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনুসারে বাংলা বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম মাতৃভাষা।

বাংলা ভাষা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা তথা সরকারি ভাষা। এছাড়াও এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামের বরাক উপত্যকার সরকারি ভাষা। বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের প্রধান কথ্য ভাষাও বাংলা। এছাড়া ভারতের ঝাড়খণ্ড, বিহার, মেঘালয়, মিজোরাম, উড়িষ্যা রাজ্যগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বাংলাভাষী মানুষ রয়েছে। ভারতে হিন্দির পরেই সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা বাংলা। সারা বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনে বাংলা ভাষা ব্যবহার করে। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত এবং ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ও স্তোত্র বাংলায় রচিত।

বাংলা ভাষার আদি উৎস ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা। মধ্য এশিয়ার পশ্চিম এবং ইউরোপের মধ্যভাগ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব ভূখণ্ডের মধ্যে যে জাতি বসবাস করত তাদের ভাষার নাম ছিল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার শাখা ২টি। যথা: কেন্তমশতম। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে আলবেনীয় ও বাল্টোস্লাভনীয় ছাড়া বাকিগুলো কেন্তমের শাখাভুক্ত। কেন্তমের এশিয়ার অন্তর্গত দুটি শাখা হল হিরিকতুখারিক। শতম শাখাভুক্ত ভাষাভাষীদের একটি গোষ্ঠী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে চলে আসে (তারা আর্য নামে পরিচিত)। এই শতম থেকেই বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে।

বাংলা ভাষার ধারাবাহিক রূপ
শতম > প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা > প্রাচীন ভারতীয় (কথ্য রূপ, সাহিত্য রূপ) > প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃত > মাগধী / গৌড়ীয় প্রাকৃত >  মাগধী গৌড়ীয় অপভ্রংশ > বাংলা

ড. মুহাম্মাদ শহীদুল্লার মতে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে ৭ম শতাব্দীতে, গৌড়ীয় প্রাকৃত থেকে। অপরদিকে ড. সুনীতি কুমার চট্টপাধ্যায়ের মতে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে ১০ম শতাব্দীতে, মাগধী প্রাকৃত থেকে।

বাংলা লিপি

লিপি হল লিখন পদ্ধতি। পৃথিবীর সকল লিপি ফিনিসিয় লিপি থেকে উদ্ভূত হয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় লিপি ২টি: ব্রাহ্মী লিপিখরোষ্ঠী লিপি। বাংলা লিপির উদ্ভব হয়েছে ব্রাহ্মী লিপি থেকে। অন্যদিকে উর্দু ও ফরাসি লিপির উদ্ভব হয়েছে খরোষ্ঠী লিপি থেকে।

মহাস্থানগড় থেকে মৌর্য সম্রাট অশোকের শাসনামলে লিখিত ব্রাহ্মীলিপি পাওয়া গেছে। ধারণা করা হয় বাংলা লিপির প্রসার ঘটেছিল পাল শাসনামলে। সেন শাসনামলে লিপি গঠন কাজ শুরু হয়। এরপর পাঠান যুগে বাংলা লিপি সাময়িক স্থায়িত্ব লাভ করেছিল।

বাংলা ছাড়াও বাংলা লিপি ব্যবহৃত হয় মণিপুরী, ককবরক ও অসমীয়া ভাষায়‌। এ লিপির গঠন তুলনামূলকভাবে কম আয়তাকার ও বেশি সর্পিল। বাংলা লিপি সিদ্ধং লিপি থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে মনে করা হয়। বর্তমানে বাংলা লিপি বিশ্বের ৬ষ্ঠ সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত লিখন পদ্ধতি।

বাংলা লিপির বিবর্তন
ব্রাহ্মী লিপি > কুষাণ লিপি > গুপ্ত লিপি > সিদ্ধমাতৃকা (সিদ্ধং – জাপানি) লিপি > বাংলা লিপি 

বাংলা ভাষারীতি (শ্রেণীবিভাগ)

বাংলা ভাষার মৌলিক রূপ দুইটি। যথা:

  • মৌখিক বা কথ্য (চলিত ও আঞ্চলিক বা উপভাষা)
  • লৈখিক বা লেখ্য (সাধু ও চলিত)

সাধু রীতি

প্রাচীনকাল থেকে সাহিত্যের ভাষা হিসেবে সাধুভাষা ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। সংস্কৃত ভাষা থেকে উৎপন্ন ভাষাকে সাধু ভাষা হিসেবে অভিহিত করা হয়। প্রথম দিকের বাংলা গদ্যে সাধুরীতির ব্যাপক প্রচলন ছিল। রাজা রামমোহন রায় সাহিত্যে প্রথম সাধু ভাষার প্রয়োগ করেন। সাধু ভাষার কিছু বৈশিষ্ট্য-

  • নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে
  • পদবিন্যাস সুনিয়ন্ত্রিত
  • গুরুগম্ভীর
  • তৎসম শব্দবহুল
  • সর্বনাম ও ক্রিয়াপদ এক বিশেষ গঠন পদ্ধতি মেনে চলে
  • সর্বনাম, ক্রিয়া ও অনুসর্গের পূর্ণরূপ ব্যবহার করা হয়
  • সাধুরীতি নাটকের সংলাপ ও বক্তৃতার অনুপযোগী

চলিত রীতি

সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকে চলিত ভাষা বলা হয়। ভাষার এ রীতি নিয়ত পরিবর্তনশীল। অঞ্চলভেদে মানুষের মুখের ভাষায় (চলিত রীতিতে) উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা যায়। বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলের জনগণ নিজ নিজ অঞ্চলের ভাষায় কথা বলে। এগুলোকে আঞ্চলিক কথ্য ভাষা বা উপভাষা বলে। পৃথিবীর সব ভাষারই উপভাষা রয়েছে। বাংলা ভাষার উপভাষা ৫টি। যথা: রাঢ়ি, ঝাড়খন্ডি, বরেন্দ্রি, বঙ্গালি কামরূপি। এক অঞ্চলের মানুষের ভাষার সাথে অন্য অঞ্চলের মানুষের ভাষায় পার্থক্যের জন্য পণ্ডিতগণ একটি আদর্শ ভাষা ব্যবহার করেন। এ ভাষাই আদর্শ চলিত ভাষা বা প্রমিত ভাষা। অর্থ্যাৎ চলিতভাষার আদর্শরূপই হল প্রমিত ভাষা। চলিত ভাষার কিছু বৈশিষ্ট্য-

  • পরিবর্তনশীল
  • তদ্ভব শব্দবহুল
  • নাটকের সংলাপ ও বক্তৃতার উপযোগী
  • সর্বনাম ও ক্রিয়াপদ- এর গঠন সহজরূপ লাভ করে
  • সর্বনাম, ক্রিয়া ও অনুসর্গের সংক্ষিপ্তরূপ ব্যবহার করা হয়

বাংলা গদ্যে চলিতরীতির প্রবর্তন করেছিলেন প্রমথ চৌধুরি। তিনি সবুজপত্র (১৯১৪) পত্রিকার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে চলিতরীতি প্রবর্তনের জন্য সংগ্রাম করেন।

উল্লেখ্য বাংলা উপভাষার শ্রেণীবিভাগে অবদান রেখেছেন ব্রিটিশ রাজ্যের উচ্চপদস্থ আমলা জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন। তিনি ১৮৭৩ সালে প্রকাশিত তার ‘লিংগুয়েস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে বাংলা উপভাষার বিভিন্ন নমুনা তুলে ধরেন।

বিভিন্ন শব্দের সাধু ও চলিত রীতি:-

সাধুচলিত
মস্তকমাথা
জুতাজুতো
তুলাতুলো
জোসনাজোছনা
সর্পসাপ
সুতাসুতো
হস্তহাত
শুষ্ক / শুকনাশুকনো
বন্যবুনো
কিয়াক্ষণকিছুক্ষণ
রঙ্গিনরঙিন
সাতিশয়অত্যন্ত
তহারা / উহারাতারা / ওঁরা
অপেক্ষাচেয়ে
পূর্বেইআগেই
করিলকরল
পাইয়াছিলেনপেয়েছিলেন
করিয়া করে

ব্যাকরণ

‘ব্যাকরণ’ (বি+আ+√কৃ+অন) শব্দটি সংস্কৃত থেকে এসেছে। এর বুৎপত্তিগত অর্থ হল বিশেষভাবে বিশ্লেষণ। ব্যাকরণকে বলা হয় ভাষার সংবিধান। এটি ভাষার প্রকৃতি ও স্বরূপ বিশ্লেষণ করে এবং অভ্যন্তরীণ নিয়মকানুন ও রীতিনীতি শৃঙ্খলাবদ্ধ করে থাকে। ব্যাকরণ মূলত ভাষা ব্যবহারের অন্তর্নিহিত তথ্য। এর কাজ হল ভাষার অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা আবিষ্কার করা। সহজ ভাষায় বলা যায়, ব্যাকরণ ভাষাকে বর্ণনা করে।

ভাষা ব্যাকরণকে অনুসরণ করে না বরং ব্যাকরণই ভাষার অনুগামী
ভাষা নদীর মত বহমান। মানুষের মুখে মুখে ভাষার ব্যবহারে যে পরিবর্তন ঘটে তাতে নতুন নিয়মের সৃষ্টি হয়। সে নিয়মগুলোই কালক্রমে ব্যাকরণের অন্তর্ভুক্ত হয়।

ব্যাকরণের ইতিহাস

ব্যাকরণ চর্চার আদিভূমি হল গ্রিস। প্লেটোর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ডায়লগ’-এ ব্যাকরণের কিছু নিয়ম-কানুনের উল্লেখ পাওয়া যায়। এরিস্টটল তার ‘পোয়েটিকস’ গ্রন্থে ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে প্রাচীনতম পরিচিত ব্যাকরণের হ্যান্ডবুকটি হল ‘আর্ট অফ গ্রামার’। এটি গ্রীক পণ্ডিত ডায়নিসিয়াস থ্রাক্স কর্তৃক রচিত। স্পষ্টভাবে এবং কার্যকরভাবে কথা বলা এবং লেখার জন্য এটি ছিল একটি সংযোগ গাইড।

প্রাচীন ও মধ্যযুগে বঙ্গদেশে প্রধানত সংস্কৃত ব্যাকরণের চর্চা হয়েছে। বাংলা ভাষার উৎপত্তি যে প্রাকৃত ভাষা থেকে, তার চর্চা হয়েছে খুব সামান্যই। পণিনি ছিলেন উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ বৈয়াকরণিক। তার বিখ্যাত ‘অষ্টাধ্যায়ী’ গ্রন্থটি সংস্কৃত ভাষার ওপর রচিত। প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাঙালির ব্যাকরণ চর্চা বলতে মোটামুটি কিছু টীকাভাষ্যকে বোঝায়।

বাংলা ব্যাকরণের ইতিহাস

ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড কর্তৃক ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত আ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ

ইউরোপীয়রা প্রথম বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনা শুরু করে। তারা নানা প্রয়োজনে ভারতবর্ষের আঞ্চলিক ভাষাসমূহ শিখতে বাধ্য হয়েছিল। নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদ থেকেই পর্তুগিজ ধর্মযাজক মানোএল দা আস্‌সুম্পসাঁউ (Manoel da Assumpcam) পর্তুগিজ ভাষায় প্রথম বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন। তিনি ১৭৩৪-৪২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে একটি গীর্জায় ধর্মযাজকের দায়িত্ব পালনকালে “Vocabolario em idioma Bengalla, e Potuguez dividido em duas partes” শীর্ষক গ্রন্থটি রচনা করেন। গ্রন্থটির প্রথম অংশ ব্যাকরণের একটি সংক্ষিপ্তসার এবং দ্বিতীয় অংশ একটি অভিধান যাতে পর্তুগিজ থেকে বাংলা এবং বাংলা থেকে পর্তুগিজ শব্দ অনুবাদ করা হয়েছে। ১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে গ্রন্থটি পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে রোমান হরফে মুদ্রিত হয়। এতে শুধু রূপতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্ব আলোচিত হয়েছে। ধ্বনিতত্ত্ব সম্পর্কে এ গ্রন্থে কোনো আলোচনা নেই।

বাংলা ভাষার দ্বিতীয় ব্যাকরণ রচয়িতা ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড। তার A Grammar of the Bengali Language প্রকাশিত হয় ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে। এটি বাংলা হরফে মুদ্রিত প্রথম ব্যাকরণ গ্রন্থ। হ্যালহেড রচিত ব্যাকরণে সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রভাব লক্ষণীয়। তিনি অনেকাংশেই বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের ছাঁচে ফেলে বিশ্লেষণ করেছেন। চার্লস উইলকিনসন এবং পঞ্চানন কর্মকার যৌথ প্রচেষ্টায় ছাপাখানার (হুগলি) জন্য যে বাংলা হরফ (font) প্রবর্তন করেছিলেন, তার সাহায্যেই হ্যালহেডের গ্রন্থে বাংলা উদাহরণগুলি মুদ্রিত হয়েছে।

বাংলা ভাষার নিজস্ব উপাদান ও স্বাতন্ত্র্যের ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রথম বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন রাজা রামমোহন রায়। ১৮২৬ সালে তার রচিত ‘Bengali Grammar in English Language’ গ্রন্থটি ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে ১৮৩৩ সালে তিনি এটিকে ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ নামে অনুবাদ করেন। এটিই বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম ব্যাকরণ গ্রন্থ হিসেবে পরিচিত।

ব্যাকরণ বিষয়ক গ্রন্থ

গ্রন্থের নামরচনার ভাষারচনাকারি
Vocabulario Em Idioma Benglla, EPoruguez. Dividido Em Duas Partesপর্তুগিজমনোএল দা আসসুম্পসাঁও
A Grammar of the Bengal Languageইংরেজীনাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড
A Grammar of the Bengali Languageইংরেজীউইলিয়াম কেরি
Bengali Grammar in English Language / গৌড়ীয় ব্যাকরণইংরেজী / বাংলারাজা রামমোহন রায়
ব্যাকরণ কৌমুদী (১৮৫৩)বাংলা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
ব্যাকরণ মঞ্জুরীবাংলাড. মুহাম্মাদ এনামুল হক
আধুনিক বাংলা ব্যাকরণবাংলাজগদীসচন্দ্র ঘোষ
The origin and development of the Bengali Languageইংরেজীড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
ভাষা প্রকাশ বাংলা ব্যাকরণবাংলা ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
প্রমীত ভাষার বাংলা ব্যাকরণবাংলারফিকুল ইসলাম ও পবিত্র সরকার
বাংলা ব্যাকরণ (১৯৫৮)বাংলাড. মুহম্মাদ শহীদুল্লাহ

এছাড়া বাংলা ভাষার কিছু অভিধান –

  • বাংলা ভাষার অভিধান – উইলিয়াম কেরী
  • শব্দমুঞ্জুরী – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
  • যথাশব্দ – মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
  • বাংলা ভাষার আঞ্চলিক অভিধান – ড. মুহম্মাদ শহীদুল্লাহ
  • বাংলা একাডেমি সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান – আহমদ শরীফ
  • প্রমিত বাংলা বানান অভিধান – জামিল চৌধুরী
  • সমকালীন বাংলা ভাষার অভিধান – আবু ইসহাক

প্রত্যেক ভাষার ব্যাকরণেই চারটি বিষয় আলোচনা করা হয়। যথা:

  • ধ্বনিতত্ত্ব (Phonology)
  • শব্দতত্ত্ব (Morphology)
  • বাক্যতত্ত্ব (Syntax)
  • অর্থতত্ত্ব (Semantics)

ধ্বনিতত্ত্ব: ধ্বনিতত্ত্বের আলচ্য বিষয় হচ্ছে বাগযন্ত্র বা ধ্বনির উচ্চারণ স্থান, ধ্বনি, ধ্বনির উচ্চারণ প্রণালী, ধ্বনি পরিবর্তন ও লোপ, ণ-তত্ব ও ষ-ত্ব বিধান, সন্ধি বা ধ্বনি সংযোগ।

শব্দতত্ত্ব বা রূপতত্ব: আলচ্য বিষয়গুলো হচ্ছে শব্দ, দ্বিরুক্ত শব্দ বা শব্দদ্বৈত, লিঙ্গ, বচন, পদাশ্রিত নির্দেশক, সমাস, উপসর্গ ও অনুসর্গ, কারক, ধাতু, পদ, অনুজ্ঞা, ক্রিয়ার কাল, ক্রিয়ামূল ও পুরুষ ইত্যাদি। এক বা একাধিক ধ্বনির অর্থবোধক সম্মিলনে শব্দ তৈরি হয়। শব্দের ক্ষুদ্রাংশকে বলা হয় রূপ। এজন্য শব্দতত্বকে রূপতত্বও বলা হয়।

অর্থতত্ত্ব: অর্থতত্ত্বের কাজ হল শব্দের অর্থবিচার, বাক্যের অর্থবিচার ও অর্থের বিভিন্ন প্রকারভেদ নির্ণয় করা। বিপরীত শব্দ, প্রতিশব্দ, শব্দজোড়, বাগধারা ইত্যাদি অর্থতত্ত্বের আলচ্য বিষয়। এছাড়া শব্দ, বর্গ ও বাক্যের ব্যঞ্জনা নিয়েও ব্যাকরণের এ অংশ আলোচনা করে। অর্থতত্ত্বের অন্যনাম বাগর্থতত্ত্ব।

বাক্যতত্ত্ব: এর আলাচ্য বিষয় হল বাক্যের সঠিক গঠনপ্রণালী, বিভিন্ন উপাদানের সংযোজন, বিয়োজন, এদের সার্থক ব্যবহারযোগ্যতা, বাক্যমধ্যে শব্দ বা পদের স্থান বা ক্রম, পদের রূপ পরিবর্তন, বাচ্য, উক্তি ইত্যাদি।

এছাড়া অভিধানতত্ত্ব, ছন্দ ও অলংকার প্রভৃতিও ব্যাকরণের আলচ্য বিষয়।


এক নজরে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো

  • মানুষের বস্তু ও ভাবের প্রতীক – ভাষা
  • ভাষার মৌলিক অংশ – ৪টি(মতান্তরে ৩টি): ধ্বনি, শব্দ, অর্থ, বাক্য।
  • ব্যকরণ ও ভাষার মধ্যে আগে সৃষ্টি হয়েছে – ভাষা
  • বাংলা ভাষার মৌলিক রূপ – ২টি (সাধু ও চলিত)
  • ভাষার কোন রীতি কেবল লেখ্যরূপে ব্যবহার করা হয় – সাধু রীতি
  • ‘সাধুভাষা’ পরিভাষাটি প্রথম ব্যবহার করেন – রাজা রামমোহন রায়
  • প্রমিত উচ্চারণ – চলিত ভাষার বৈশিষ্ট্য
  • উপভাষা কি – অঞ্চল বিশেষের মানুষের মুখের ভাষা
  • নাটকের সংলাপে অনুপযোগী – সাধুভাষা
  • সাধুভাষা থেকে চলিত ভাষায় লিখতে কোন পদযুগলের পরিবর্তন হয় – সর্বনাম ও ক্রিয়া
  • লোকজ শব্দ ‘দইয়ল’ এর প্রমিত রুপ হলো – দোয়েল
  • ব্যাকরণ শব্দটি এসেছে – সংস্কৃত ভাষা থেকে
  • ব্যাকরণ শব্দের বুৎপত্তি কোনটি – বি+আ+√কৃ+অন
  • ব্যাকরণ শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ – বিশেষভাবে বিশ্লেষণ
  • ব্যাকরণের প্রধান কাজ – ভাষার বিশ্লেষণ
  • বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ রচনা করেন – মনোএল দ্য আসসুম্পসাঁও
  • বাংলা ব্যাকরণ প্রথম বাংলা টাইপ সহকারে রচনা করেন – এন. বি. হ্যালহেড
  • রাজা রামমোহন রায় রচিত বাংলা ব্যাকরণের নাম – গৌড়ীয় ব্যাকরণ
  • ‘The origin and development of the Bengali language’ গ্রন্থটি রচনা করেছেন- ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
  • ‘সন্ধি’ ব্যাকরণের কোন অংশের আলচ্য বিষয় – ধ্বনিতত্ত্ব
  • ‘ণ-তত্ত্ব’ ও ‘ষ-তত্ত্ব’ বিধান ব্যাকরণের কোন অংশের আলচ্য বিষয় – ধ্বনিতত্ত্ব
  • কারক সম্পর্কে আলোচনা করা হয় – রূপতত্ত্ব
  • রূপতত্ত্বের অপর নাম – শব্দতত্ত্ব

56
Created on By admin

ভাষা ও ব্যাকরণ

বিগত সালের প্রশ্ন

1 / 19

ভাষার কোন রীতি নাটকের সংলাপ ও বক্তৃতায় অনুপযোগী?

2 / 19

‘সন্ধি’ ব্যাকারণের কোন অংশের আলচ্য বিষয়?

3 / 19

কোনটি চলিত ভাষার বৈশিষ্ট্য?

4 / 19

কোনটি ভাষার বৈশিষ্ট্য নয়?

5 / 19

লোকজ শব্দ 'দইয়ল' এর প্রমিত রূপ হলো-

6 / 19

বাংলা ভাষার মৌলিক রূপ কয়টি?

7 / 19

ভাষার মৌলিক অংশ কয়টি?

8 / 19

ব্যাকারণের প্রধান কাজ হচ্ছে-

9 / 19

'সাধুভাষা' পরিভাষাটি প্রথম ব্যবহার করেন-

10 / 19

নিচের যে শব্দগুচ্ছ একই পরিবারভুক্ত নয়-

11 / 19

মানুষের মুখে উচ্চারিত অর্থবোধক ও মনোভাব প্রকাশক ধ্বনির সমষ্টিকে বলে-

12 / 19

ব্যাকারণ ও ভাষার মধ্যে কোনটি আগে সৃষ্টি হয়েছে?

13 / 19

সাধু ও চলিত রীতিতে অভিন্নরূপে ব্যবহৃত হয়?

14 / 19

কোন বিদেশি পণ্ডিত বাংলা উপভাষার শ্রেণীবিন্যাসে বিশেষ অবদান রাখেন?

15 / 19

ব্যাকারণ শব্দের বুৎপত্তি কোনটি?

16 / 19

সাধুভাষা থেকে চলিতভাষা লিখতে কোন পদযুগলের পরিবর্তন ঘটে?

17 / 19

বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকারণ রচনা করেন কে?

18 / 19

রাজা রামমোহন রায় রচিত বাংলা ব্যাকারণের নাম কী?

19 / 19

কেন্তমের কোন দুটি শাখা এশিয়ার অন্তর্গত?

Your score is

The average score is 76%

0%


References

Wikipedia.com

অনুরূপ পোস্ট

আরও পোস্ট: বাংলা ভাষা আর্কাইভ

Leave a Reply