১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলে তৎকালীন পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনরা আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে তালবাহানা শুরু করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২রা মার্চ, ১৯৭০ (সারাদেশে ৩রা মার্চ) অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়।
ঘটনাবলি
মার্চ মাসের ঘটনাবলি
১৯৭১ এর উত্তাল মার্চেই মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সশস্ত্র রূপ লাভ করে।
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ও স্বাধীন বাংলা ছাত্র পরিষদ গঠন
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন।
চার ছাত্রনেতা এক বৈঠকে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করেন। এ ৪ জন নেতা হলেন:
- নূরে আলন সিদ্দিকী (ছাত্রলীগ সভাপতি)
- সাজাহান সিরাজ (ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক)
- আ.স.ম আব্দুর রব (ডাকসু সহ-সভাপতি)
- আব্দুল কুদ্দুস মাখন (ডাকসু সাধারণ সম্পাদক)
এ চারজন বঙ্গবন্ধুর চার খলিফা নামে পরিচিত।
অসহযোগ আন্দোলন
বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ২রা মার্চ ঢাকা শহর এবং ৩রা মার্চ থেকে সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ২৫ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার মধ্য দিয়ে অসহযোগ আন্দোলন সমাপ্ত হয়।
ছাত্র নেতাদের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় প্রথম মানচিত্র খচিত বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন ডাকসু সহ-সভাপতি আ. স. ম. আব্দুর রব। এজন্য ২রা মার্চ জাতীয় পতাকা দিবস।
স্বাধীনতার ইসতেহার পাঠ, বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহিদ
পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ আয়োজিত এক বিক্ষোভ সমাবেশে ৫ দফা ভিত্তিক স্বাধীনতার ইসতেহার পাঠ করা হয়। সমাবেশে ডাকসু ভিপি আ.স.ম. আব্দুর রব বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির জনক’ ঘোষণা করেন।
অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে রংপুরে ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র শম্ভু সমজদার নিহত হন। তাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহিদ বলা হয়।
রেডিওর নাম পরিবর্তন
পাকিস্তান রেডিওর নাম বাংলাদেশ বেতার এবং পাকিস্তান টিভির নাম বাংলাদেশ টিভি করা হয়।
নতুন গভর্নর নিয়োগ ও সংসদ অধিবেশনের তারিখ ঘোষণা
‘বেলুচিস্তানের কসাই’ নামে কুখ্যাত লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ সংসদ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা করেন।
৭ই মার্চের ভাষণ
বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় এক ঐতিহাসিক ভাষণ রাখেন। উক্ত জনসভায় কোন প্রধান অতিথি ছিল না এবং একমাত্র বক্তা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বিকাল ৩টা ২০ মিনিটে শুরু হয়ে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য ২৩ মিনিট (রেকর্ড হয়েছে ১৮-১৯ মিনিট) স্থায়ী হয়েছিল। ভাষণের বিষয়বস্তু/দাবি ছিল ৪টি। যথা:
- সামরিক আইন প্রত্যাহার
- সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরে যাওয়া
- গণহত্যার তদন্ত
- নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠন UNESCO বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে ২০১৭ সালে ঐতিহাসিক দলিল বা বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। ৭ই মার্চের ভাষণের উপর ২০১২ সালে নির্মিত হয় চলচ্চিত্র ‘দ্য স্পিট’। এর পরিচালক ফখরুল আরেফিন।
জাতীয় ফুল নির্ধারণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের এক সভায় শিল্পী কামরুল হাসান ঘোষণা করেন- “গ্রাম বাংলার খাল বিলের ভাসমান শাপলা ফুলই হবে বাংলাদেশের জাতীয় ফুল”।
চট্টগ্রামে অস্ত্রবোঝাই জাহাজ
পাকবাহিনীর অস্ত্রবোঝাই জাহাজ ‘সোয়াত’ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে। এদিন অপারেশন সার্চলাইট চূড়ান্ত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ
পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ সংঘঠিত হয় জয়দেবপুরে (গাজীপুর)। পাকবাহিনী বাঙ্গালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা চালালে বাঙালি সেনা ও জনতা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশন্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা। এদিন জয়দেবপুরে প্রায় ৫০ জন শহিদ হন এবং প্রায় দুই শতাধিক আহত হন।
জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঢাকায় আগমণ
জুলফিকার আলী ভুট্টো নিজ প্রতিনিধি দলসহ ঢাকায় আসেন।
শেখ মুজিব, ভুট্টো, ইয়াহিয়া আলোচনা
শেখ মুজিব, ভুট্টো, ইয়াহিয়া আলোচনায় বসেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আবারও পূর্ব ঘোষিত ২৫ মার্চের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করেন।
অস্ত্র খালাস
‘সোয়াত’ থেকে অস্ত্র খালাস করা হয়। এসময় বন্দরের শ্রমিক ও সাধারণ জনতা বাধা দিলে তাদের ওপর গুলি চালানো হয়।
কালো রাত, গণহত্যা দিবস
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। রাত প্রায় সাড়ে ১১ টার দিকে অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয়। এদিন পাকিস্তানি বাহিনী ব্যপক হত্যাযজ্ঞ চালায়।
সরকার ২০১৭ সালে দিনটিকে গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে।
স্বাধীনতা ঘোষণা
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ৬৭৭ নম্বর বাড়ি থেকে রাত ১টার দিকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নেওয়া হয়। তাকে গ্রেপ্তারের পর ওয়ালেসে বার্তা পাঠানো হয়েছিল – ‘বিগ বার্ড ইন কেজ, স্মল বার্ডস হ্যাভ ফ্লোন’।
বঙ্গবন্ধু ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
দুপুর ২:৩০ মিনিটের দিকে আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ. হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন। ঘোষণাটি ছিল ইংরেজিতে। পরে মমতাজউদ্দীন আহমেদ ইংরেজি ঘোষণাটি বাংলা করেন এবং আবুল কাশেম সন্দীপ ঐদিনই বাংলা ঘোষণাটি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করেন।
মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ
মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে পুনরায় স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়।
এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাসের ঘটনাবলি
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যাত্রা শুরু
ত্রিপুরার আগারতলা থেকে স্বাধীন বাংলা বেতারের যাত্রা শুরু হয়।
সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদোগার্নি গণহত্যা বন্ধের জন্য ইয়াহিয়া খানকে চিঠি দেন।
তেলিয়াপাড়া রণকৌশল
তৎকালীন সিলেটের (বর্তমান হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলা) তেলিয়াপাড়ায় চা বাগানের ম্যানেজারের কক্ষে কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে ২৭ জন বাঙালী সেনা কর্মকর্তাসহ এক বৌঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল ঠিক করা হয় এবং মুক্তিফৌজ (পরবর্তীতে মুক্তিবাহিনী) গঠন করা হয়। মূলত এসময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের নিয়েই মুক্তিফৌজ গঠিত হয়েছিল। পরবর্তীতে এর সাথে সর্বস্তরের মানুষ যুক্ত হয়ে মুক্তবাহিনী গঠিত হয়।
জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব উত্থাপন করে। রাশিয়া ও পোল্যান্ড বিপক্ষে ভোট দেয়।
বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের মৃত্যু
৮নং সেক্টরে যুদ্ধরত অবস্থায় সিপাহি মোস্তফা কামাল শহিদ হন।
শান্তি কমিটি গঠন
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী প্রথম সংগঠন ‘শান্তি কমিটি’ গঠিত হয়।
মুজিবনগর সরকার গঠন ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি
এদিন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার তথা মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়।
মুজিবনগর সরকারের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করেন। ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলী। ঘোষণাপত্রটি ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হয়। অর্থ্যাৎ এ ঘোষণাপত্র অনুযায়ী ২৬ মার্চ ১৯৭১ তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে এ ঘোষণাপত্র অনুযায়ী দেশ পরিচালিত হয়েছে।
কলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডে অফিস স্থাপন করে মন্ত্রিসভা গঠন করেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।
দেশকে ৪ টি সেক্টরে ভাগ করা হয়।
মুজিবনগর সরকার গঠনের ঘোষণা প্রদান
তাজউদ্দিন আহমেদ বেতার ভাষণে মুজিবনগর সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করেন।
মুক্তিফৌজের নাম পরিবর্তন করে মুক্তিবাহিনী রাখা হয়। পূর্বের ৪ সেক্টরের পরিবর্তে দেশকে ১১টি সেক্টর, ৬৪টি সাব-সেক্টর, ৩টি ব্রিগেড ফোর্সে ভাগ করা হয়।
মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীপরিষদ ঘোষণা
- বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয়।
- এম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি ও মুক্তিবাহিনীর প্রধান ঘোষণা করা হয়।
- কলকাতার ৮ নং থিয়েটার রোডের সদরদপ্তরে বাংলাদেশ বাহিনী তার কর্যক্রম শুরু করে।
মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ
মেহেরপুরের মুজিবনগরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহণ করে। এ সরকারকে মুজিবনগর সরকারও বলা হয়। এদিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠ করা হয় এবং সেটি গৃহীত হয়। ঘোষণাপত্র পাঠ করেন গণপরিষদের স্পিকার অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী। শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আব্দুল মান্নান।
বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আবদুর রউফের মৃত্যু
১নং সেক্টরে যুদ্ধরত অবস্থায় ল্যান্স নায়েক মুন্সি আবদুর রউফ শহিদ হন।
আল বদর বাহিনী গঠন
পাক বাহিনীর সহায়তাকারী আধাসামরিক আল বদর বাহিনী গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যার সাথে এ বাহিনী জড়িত ছিল।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠন
জাকারিয়া পিন্টুর অধিনায়কত্বে ৩৪ জন খেলোয়ারসহ মোট ৩৬ জন সদস্য নিয়ে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠিত হয়।
The Concert for Bangladesh
বাংলাদেশী শরণার্থীদের জন্য সাহায্য সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে নিউইয়র্ক সিটির ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে বিটল্স সঙ্গীতদলের লিড গিটারবাদক জর্জ হ্যারিসন এবং ভারতীয় সেতারবাদক রবিশঙ্কর কর্তৃক বেনিফিট কনসার্ট আয়োজিত হয়। বব ডিলান এ কনসার্টে সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের মৃত্যু
বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফেন্যান্ট মতিউর রহমান পাকিস্তান বাহিনীর টি-৩৩ বিমান ছিনতাই করে দেশে ফেরার পথে শহিদ হন।
ডাঃ মালিক মন্ত্রিসভা গঠন
ডাঃ এ. এম. মালিক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন।
তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মাদ শেখ-এর মৃত্যু
ইপিআর এর ল্যন্স নায়ক নূর মোহাম্মদ শেখ যশোরে শহিদ হন হন।
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের মৃত্যু
সেনাবাহিনীর সিপাহী হামিদুর রহমান শহিদ হন।
মিত্রবাহিনী গঠন
মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী মিলে যৌথ বাহিনী গঠিত হয়।
- বাহিনী প্রধান: ভারতের সেনাপ্রধান শ্যাম জামসেদজি মানকেশ
- অধিনায়ক: লে. জে. জগজিৎ সিং আরোরা
- ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ: লে. জে. জ্যাকব ফার্জ রাফায়েল
ডিসেম্বর মাসের ঘটনাবলি
ভারতে বিমান হামলা
পাকিস্তান ভারতে বিমান হামলা চালায়। ফলে ভারতের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া নিশ্চিত হয়ে পড়ে।
সোভিয়েতের প্রস্তাবে চীনের ভেটো
জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের আনীত প্রস্তাবে চীন ভেটো প্রদান করে।
যশোরের শত্রু মুক্তি ও প্রথম স্বীকৃতি
প্রথম জেলা হিসেবে যশোর শত্রু মুক্ত হয়।
প্রথমে ভুটান ও তার কিছুক্ষণ পরে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের মৃত্যু
নৌবাহিনীর স্কোয়াড্রন ইঞ্জিনিয়ার রুহুল আমিন শহিদ হন।
সোভিয়েত ভেটো
সোভিয়েত ইউনিয়ন ৩য় বারের মত জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভেটো দেয়।
বুদ্ধিজীবী হত্যা ও ডাঃ মালিক মন্ত্রীসভার পদত্যাগ
বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহঙ্গীরের পাক বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে শহিদ হন।
পাকবাহিনী তাদের এদেশীও দোসরদের সহযোগীতায় দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। এদিন শহীদুল্লাহ কায়সার, আনোয়ার পাশা, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সেলিনা পারভীন, মুনীর চৌধুরিসহ অনেকে নিহত/গুম হন।
ডাঃ মালিক মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করে হোটেল সেরাটনে আশ্রয় গ্রহণ করে।
আত্মসমার্পণের সময়সীমা
ভারতের সেনাপ্রধান পাকিস্তানকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯:০০ টার মধ্যে আত্মসমর্পণের সময়সীমা বেঁধে দেন। পরবর্তীতে যা বিকাল ৩:০০টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
চুড়ান্ত বিজয়
বিকাল ৪টা নাগাদ পাকিস্তানী বাহিনী যৌথবাহিনীর নিকট রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ৯১ হাজার সৈন্যসহ আত্মসমার্পণ করে। আত্মসমার্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন-
- যৌথ বাহিনীর পক্ষে লে. জেনারেল জগজিত সিং আরোরা
- পাকিস্তান বাহিনীর পক্ষে আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি
স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন মুক্তিযুদ্ধের উপ-সেনাপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খন্দকার বা এ. কে খন্দকার।
মুক্তিযুদ্ধের সামরিক কমান্ড
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টর ও ৬৪ টি সাবসেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল।
সেক্টর

সেক্টর অধিনায়ক
- ১নং সেক্টর: মেজর জিয়াউর রহমান (এপ্রিল- জুন) ও ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম (জুন-ডিসেম্বর)।
- ২নং সেক্টর: মেজর খালেদ মোশাররফ (এপ্রিল-অক্টোবর) ও ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার (অক্টোবর- ডিসেম্বর)
- ৩নং সেক্টর: মেজর কে. এম. শফিউল্লাহ্ (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) ও মেজর এ.এন.এম. নুরুজ্জামান (অক্টোবর-ডিসেম্বর)।
- ৪নং সেক্টর: মেজর সি. আর. দত্ত (মে-ডিসেম্বর)।
- ৫নং সেক্টর: মেজর মীর শওকত আলী (আগস্ট- ডিসেম্বর)
- ৬নং সেক্টর: উইং কমান্ডার এম. কে. বাশার (জুন-ডিসেম্বর)
- ৭নং সেক্টর: মেজর খন্দকার নাজমুল হক (এপ্রিল-আগস্ট) ও মেজর কিউ. এন. জামান (আগস্ট-ডিসেম্বর)।
- ৮নং সেক্টর: মেজর এম. এ. মঞ্জুর (আগস্ট- ডিসেম্বর); (দায়িত্ব বুঝে নেয়ার আগে মেজর , পরবর্তীকালে লেঃ কর্ণেল)। এম. এ. ওসমান চৌধুরী (এপ্রিল-আগস্ট) এই সেক্টরে অভিযান পরিচালনা করেন।
- ৯নং সেক্টর: ক্যাপ্টেন এম. এ. জলিল (এপ্রিল-ডিসেম্বর)।
- ১০নং সেক্টর: কোন নির্দিষ্ট এলাকা ছিল না। এটি ছিল সমন্বিত বাহিনী।
- ১১নং সেক্টর: মেজর জিয়াউর রহমান (জুন-আগস্ট), মেজর এ. তাহের (আগস্ট-নভেম্বর) এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম. হামিদুল্লাহ (নভেম্বর-ডিসেম্বর)।
ফোর্স
নাম | অন্তর্ভুক্ত ইউনিট | অধিনায়ক |
---|---|---|
জেড ফোর্স | ১, ৩ ও ৮ | লে. কর্নেল জিয়াউর রহমান |
এস ফোর্স | ২ ও ১১ | লে. কর্নেল কে. এম. শফিউল্লাহ |
কে ফোর্স | ৪, ৯ ও ১০ | লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফ |
খেতাব
১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বসূচক অবদানের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের আনুষ্ঠানিকভাবে খেতাব প্রদান করা হয়। খেতাবপ্রাপ্ত মোট মুক্তিযোদ্ধা ৬৭২ জন। এর মধ্যে ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ, ৬৭ জন বীর উত্তম, ১৭৪ জন বীর বিক্রম ও ৪২৪ জন বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন। উল্লেখ্য ৬ জুন ২০২১ তারিখে বঙ্গবন্ধুর ৪জন খুনির খেতাব বাতিল হওয়ায় খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৬৭৬ জন থেকে কমে ৬৭২ জন হয়।
বীরশ্রেষ্ঠ – ৭ জন
খেতাবপ্রাপ্ত সবাই মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হন। বীরশ্রেষ্ঠদের মধ্যে সেনাবাহিনীর ৩ জন, ইপিআরের ২ জন, নৌবাহিনীর ১ জন ও বিমানবাহিনীর ১ জন সদস্য আছেন। বীরশ্রেষ্ঠদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়-
ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ
জন্ম: ফরিদপুর, মৃত্যু: ৮ এপ্রিল ১৯৭১, কর্মস্থল: ইপিআর, সমাধি: রাঙামাটি শহরে
পার্বত্য চট্টগ্রামের বুড়িঘাট গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে মর্টার শেলের আঘাতে শহিদ হন।
সিপাহী মোস্তফা কামাল
জন্ম: ভোলা, মৃত্যু: ১৮ এপ্রিল ১৯৭১, কর্মস্থল: সেনাবাহিনী, সমাধি: ব্রহ্মণবাড়িয়া
পাকবাহিনীর হাতে ধৃত অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
ল্যান্স নায়ক নূর মোহাম্মদ শেখ
জন্ম: নড়াইল, মৃত্যু: ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১, কর্মস্থল: ইপিআর, সমাধি: যশোর
যশোরে পাকবাহিনীর হাতে ধৃত আবস্থায় নিহত হন।
সিপাহী হামিদুর রহমান
জন্ম: ঝিনাইদহ, মৃত্যু: ২৮ অক্টোবর ১৯৭১, কর্মস্থল: সেনাবাহিনী, সমাধি: মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থান
তিনি সর্বকনিষ্ঠ শহিদ বীরশ্রেষ্ঠ। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর।
ফ্লাইট লেফটেন্যন্ট মতিউর রহমান
জন্ম: ঢাকা, পৈতৃক নিবাস: নরসিংদী, মৃত্যু: ২৯ অক্টোবর ১৯৭১, কর্মস্থল: বিমানবাহিনী, সমাধি: মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থান
পাকবাহিনীর বিমান ছিনতাই করে নিয়ে আসার সময় নিহত হন।
স্কোয়াড্রন ইঞ্জিনিয়ার রুহুল আমিন
জন্ম: নোয়াখালী, মৃত্যু: ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১, কর্মস্থল: নৌবাহিনী, সমাধি: খুলনা
রাজাকারদের হাতে ধৃত অবস্থায় নিহত হন।
ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর
জন্ম: বরিশাল, মৃত্যু: ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, কর্মস্থল: সেনাবাহিনী, সমাধি: চাঁপাইনবাবগঞ্জ
তার সম্মানে ঢাকা সেনানিবাসের প্রধান ফটকের নাম “শহিদ জাহাঙ্গীর গেট” নামকরণ করা হয়েছে।
বীর উত্তম – ৬৮ জন
বেসামরিক বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র ব্যক্তি হলেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দীকী। সর্বশেষ বীর-উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমেদ (২০১০) মরণোত্তরসহ মোট বীর-উত্তম ৬৮ জন। বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের আগস্টে বাঁচানোর চেষ্টার জন্য তাকে ২০১০ সালে মরণোত্তর বীর-উত্তম খেতাব প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত ৬৭ জন। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর খুনি লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিমের বীর উত্তম খেতাব বাতিল করা হয়েছে।
বীর বিক্রম – ১৭৪ জন
একমাত্র আদিবাসী বীর বিক্রম উক্যচিং মারমা (৬ নং সেক্টর)। উল্লেখ্য বঙ্গবন্ধুর খুনি লে. কর্নেল নূর চৌধুরির বীর বিক্রম খেতাব বাতিল করা হয়েছে।
বীর প্রতীক – ৪২৪ জন
বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্ত সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। এছাড়া বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত বিদেশী মুক্তিযোদ্ধা ডব্লিউ এস ওডারল্যান্ড। বীর প্রতিক নারী মুক্তিযোদ্ধা ২ জন: ক্যাপ্টেন ডা: সেতারা বেগম (২নং সেক্টর) ও তারামন বিবি (১১ নং সেক্টর)। বঙ্গবন্ধুর দুই খুনি লে. এম এ রাশেদ চৌধুরি ও নায়েক সুবাদার মোসলেম উদ্দিন খানের বীর প্রতীক খেতাব বাতিল করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম