সমাস শব্দের অর্থ সংক্ষেপণ, মিলন, একাধিক পদের একপদীকরণ। পরস্পর অর্থসঙ্গতি সম্পন্ন দুই বা ততোধিক পদের এক পদে পরিণত হওয়াকে সমাস বলে। বাক্যে শব্দের ব্যবহার সংক্ষিপ্ত করার উদ্দেশ্যে সমাসের সৃষ্টি। এটি নতুন শব্দ তৈরি ও ব্যবহারের একটি বিশেষ রীতি। সংস্কৃত ভাষা থেকে এই রীতি বাংলা ভাষায় এসেছে। তবে খাঁটি বাংলা সমাসের দৃষ্টান্তও পাওয়া যায়।
উদাহরণ: “বিলাত ফেরত রাজকুমার সিংহাসনে বসলেন।” এখানে ‘বিলাত-ফেরত’, ‘রাজকুমার’ ও ‘সিংহাসন’ শব্দগুলো সমাসবদ্ধ পদ। সমাস সম্পর্কিত কিছু শব্দ-
- সমস্ত পদ: সমাসবদ্ধ বা সমাস নিষ্পন্ন পদটির নাম সমস্ত পদ।
- সমাস্যমান পদ: যে যে পদে সমাস হয় তাদের প্রত্যেককে সমস্যমান পদ বলে।
- পূর্বপদ: সমাসযুক্ত পদের প্রথম অংশ, পরপদ: সমাসযুক্ত পদের শেষ অংশ
- ব্যাসবাক্য বা বিগ্রহবাক্য: সমস্ত পদকে ভাঙলে যে বাক্যাংশ পাওয়া যায় তাকে ব্যাসবাক্য বা বিগ্রহবাক্য বলে।
উদাহরণ: সিংহ চিহ্নিত আসন = সিংহাসন; এখানে সমস্তপদ = সিংহাসন; সমাস্যমান পদ= ‘সিংহ’ ও ‘আসন’; পূর্বপদ = সিংহ (সিংহাসন) এবং পরপদ = আসন (সিংহাসন)। অনুরূপভাবে –
- নীল যে আকাশ = নীলাকাশ। এখানে সমস্তপদ = ‘নীলাকাশ’; সমস্যমান পদ দুটি: ‘নীল’, ‘আকাশ’; পূর্বপদ = নীল; পরপদ = আকাশ; ব্যাসবাক্য = নীল যে আকাশ।
- বিলাত হতে ফেরত= বিলাতফেরত। এখানে সমস্তপদ = ‘বিলাতফেরত‘; সমস্যমান পদ = ‘বিলাত‘, ‘ফেরত‘; পূর্বপদ = বিলাত; পরপদ = ফেরত; ব্যাসবাক্য = বিলাত হতে ফেরত।
- রাজার পুত্র = রাজপুত্র। এখানে সমস্তপদ = ‘রাজপুত্র’; সমস্যমান পদ = ‘রাজার’, ‘পুত্র’; পূর্বপদ = রাজা; পরপদ = পুত্র; ব্যাসবাক্য = রাজার পুত্র।
- মীনের অক্ষির ন্যায় অক্ষি যার = মীনাক্ষি। এখানে সমস্তপদ = মীনক্ষি; সমস্যমান পদ = ‘মীনের‘ ও ‘অক্ষি‘; পূর্বপদ = মীন; পরপদ = অক্ষি; ব্যাসবাক্য = মীনের অক্ষির ন্যায় অক্ষি যার।
সন্ধি ও সমাসের পার্থক্য
সন্ধিতে মিলন ঘটে সন্নিহিত ধ্বনি বা বর্ণের, সমাসে মিলন ঘটে পাশাপাশি থাকা দুই, তিন বা তার বেশি সংখ্যক পদের। যেমন: সংখ্যা+অতীত= সংখ্যাতীত; সংখ্যাকে অতীত= সংখ্যাতীত।
সমাস মূলত ৪ প্রকার । যথা:
- দ্বন্দ সমাস
- কর্মধারায় সমাস
- তৎপুরুষ সমাস
- বহুব্রীহি সমাস
বৈশিষ্ট্যের বিচারে সমাসগুলো –
দ্বন্দ সমাস | উভয়পদের অর্থ প্রাধান্য পায় |
কর্মধারয় সমাস | পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায় |
তৎপুরুষ সমাস | পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায় |
বহুব্রীহি সমাস | পূর্ব ও পর কোন পদকে প্রাধান্য না দিয়ে তৃতীয় কোন ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে |
দ্বন্দ্ব সমাস
যে সমাসে প্রত্যেকটি সমাস্যমান পদের অর্থের প্রাধান্য থাকে তাকে দ্বন্দ্ব সমাস বলে। এ সমাসের উভয় পদই (পূর্বপদ ও পরপদ) সমজাতীয় পদ হয়। অর্থ্যাৎ পূর্বপদ বিশেষ্য হলে পরপদও বিশেষ্য হবে। অনুরূপভাবে পূর্বপদ বিশেষণ, সর্বনাম বা ক্রিয়া হলে পরপদটিও যথাক্রমে বিশেষণ, সর্বনাম বা ক্রিয়া হবে। দ্বন্দ্ব সমাসে এবং, ও, আর অব্যয় পদ ব্যবহার করা হয়। যেমন: আলো ও ছায়া = আলোছায়া, নয় ও ছয় = নয় ছয়, জমা ও খরচ = জমাখরচ। বিভিন্ন প্রকার দ্বন্দ্ব সমাস –
- অলুক দ্বন্দ্ব: যে দ্বন্দ্ব সমাসে বিভক্তি লোপ পায় না তাই অলুক দ্বন্দ্ব সমাস। যেমন: হাতে ও কলমে = হাতে-কলমে। অনুরূপ: কোলেপিঠে, ঘরে-বাইরে ইত্যাদি।
- বহুপদী দ্বন্দ্ব: তিন বা বহু পদের দ্বন্দ্ব সমাসই বহুপদী দ্বন্দ্ব সমাস। যেমন: সাহেব, বিবি ও গোলাম = সাহেব-বিবি-গোলাম।
- একশেষ দ্বন্দ্ব: প্রধান পদটি অবশিষ্ট থেকে অন্যপদ লুপ্ত হলে বা শেষপদ অনুসারে শব্দের রূপ নির্ধারিত হলে তাকে একশেষ দ্বন্দ্ব সমাস বলে। যেমন: সে, তুমি ও আমি = আমরা; এখানে শেষপদ ‘আমি’ অনুসারে সমস্তপদ ‘আমরা’ নির্ধারিত হয়েছে। অনুরূপ, জয়া ও পতি = দম্পতি, তুমি ও সে = তোমরা, কাকা, মামা ও বাবা = বাবারা ইত্যাদি।
- সমার্থক দ্বন্দ্ব: কাজ ও কর্ম = কাজ-কর্ম। অনুরূপ: হাট-বাজার, নাম-ডাক, আইন-আদালত, সেবাযত্ন ইত্যদি।
- মিলনার্থক দ্বন্দ্ব: মা ও বাপ = মা-বাপ। অনুরূপ: ভাই-বোন, লাউ-কুমড়া, চা-বিস্কুট ইত্যাদি।
- বিরোধার্থক দ্বন্দ্ব: দা ও কুমড়া = দা-কুমড়া। অনুরূপ: অহি-নকুল, সাদা-কালো ইত্যাদি।
- বিপরীতার্থক দ্বন্দ্ব: আয় ও ব্যয় = আয়-ব্যয়, ছোট ও বড় = ছোট-বড় ইত্যাদি।
- সর্বনামযোগে গঠিত দ্বন্দ্ব: যা ও তা = যা-তা, যথা ও তথা = যথা-তথা ইত্যাদি।
কর্মধারায় সমাস
বিশেষ্য ও বিশেষণ পদ মিলে যে সমাস তাকে কর্মধারায় সমাস বলে। যেমন: নীল যে উৎপল = নীলোৎপল, গোলাপ নামের ফুল = গোলাপফুল ইত্যাদি। কর্মধারয় সমাসে পর/উত্তর পদের অর্থই প্রধান হয়। কর্মধারয় সমাস প্রধানত পাঁচ প্রকার। যথা:-
সাধারণ কর্মধারয়
বিশেষ্য ও বিশেষণ, বিশেষ্য ও বিশেষ্য অথবা বিশেষণ ও বিশেষণ পদের মধ্যে যে সমাস তাই সাধারণ কর্মধারয় সমাস। যেমন:
- মহান যে নবী = মহানবী
- মহান যে জন = মহাজন
- নীল যে আকাশ = নীলাকাশ
- উড়ে যে জাহাজ = উড়োজাহাজ
- জন যে এক = জনৈক
- কু যে পুরুষ = কাপুরুষ
- খাস যে মহল = খাসমহল
- কাঁচা যে কলা = কাঁচকলা
- ভাজা যে বেগুন = বেগুনভাজা
- সিদ্ধ যে আলু = আলুসিদ্ধ
- যে চাঁপা =
- চিত যে সাঁতার = চিতসাঁতার
- যিনি জজ তিনিই সাহেব = জজসাহেব
- যিনি মৌলভী তিনিই সাহেব = মৌলভীসাহেব
- যিনি রাজা তিনিই ঋষি = রাজর্ষি
- যিনি লাট তিনিই সাহেব = লাটসাহেব
- খানিক কাঁচা খানিক পাকা = কাঁচাপাকা
- যা কাঁচা তা-ই মিঠা = কাঁচামিঠা
- যে শান্ত সেই শিষ্ট = শান্তশিষ্ট
- যে চালাক সেই চতুর = চালাকচতুর
মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস
ব্যাসবাক্যের মধ্যপদ বিলুপ্ত হয়ে যে কর্মধারয় সমাস গঠিত হয় তাই মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস। যেমন: সিংহ চিহ্নিত আসন = সিংহাসন; এখানে “চিহ্নিত” পদটি বিলুপ্ত হয়েছে। আরও –
- সাহিত্য বিষয়ক সভা = সাহিত্যসভা
- স্মৃতি রক্ষার্থে সৌধ = স্মৃতিসৌধ
- জ্যোৎস্না শোভিত রাত = জ্যোৎস্নারাত
- সংবাদ যুক্ত পত্র = সংবাদপত্র
- প্রাণ যাওয়ার ভয় = প্রাণভয়
- পল (মাংস) মিশ্রিত অন্ন = পলান্ন
- বৌ পরিবেশন করা ভাত = বৌভাত
- হাতে পড়া হয় যে ঘড়ি = হাতঘড়ি
- ঘরে আশ্রিত জামাই = ঘরজামাই
- ঘি মাখা ভাত = ঘিভাত
- চালে ধরে যে কুমড়া = চালকুমড়া
- ছায়া প্রদান করে যে তরু = ছায়াতরু
- ধর্ম রক্ষার্থে যে ঘট = ধর্মঘট
- বিজয় নির্দেশক পতাকা = বিজয়-পতাকা
তুলনার ক্ষেত্রে সমাস সম্পর্কিত কিছু শব্দ-
উপমান পদ: যার সাথে তুলনা করা হয়।
উপমেয় পদ: যাকে তুলনা করা হয়।
সাধারণ ধর্ম: উপমান ও উপমেয় পদের একটি সাধারণ ধর্ম বা গুণ থাকে।
উদাহরণ: ভ্রমরের ন্যায় কৃষ্ণ কেশ। এখানে ভ্রমর উপমান পদ, কেশ উপমেয় পদ এবং কৃষ্ণ (কালো) তাদের সাধারণ ধর্ম (ভ্রমর ও কেশ উভয়ের সাধারণ রং কালো)।
উপমান কর্মধারয় সমাস
উপমান পদের সাথে সাধারণ ধর্মবাচক পদের মিলনে যে সমাস হয়, তাকে উপমান কর্মধারয় সমাস বলে। যেমন: শশের (খরগোশের) ন্যায় ব্যস্ত = শশব্যস্ত। এখানে ‘শশ’ উপমান পদ এবং ‘ব্যস্ত’ সাধারণ ধর্ম। অনুরূপ-
- বকের ন্যায় ধার্মিক = বকধার্মিক
- বজ্রের ন্যায় কণ্ঠ = বজ্রকণ্ঠ
- তুষারের ন্যায় শুভ্র = তুষারশুভ্র
- কুসুমের ন্যায় কোমল = কুসুমকোমল
- কাজলের ন্যায় কালো = কাজলকালো
- অরুণের মত রাঙা = অরুণরাঙা
- মিশের ন্যায় কালো = মিশকালো
- গজের ন্যায় মূর্খ = গজমূর্খ ইত্যাদি। উল্লেখ্য গজ শব্দের অর্থ হাতি।
উপমিত কর্মধারয় সমাস
সাধারণ ধর্মবাচক পদের প্রয়োগ না থাকলে উপমেয় ও উপমান পদের যে সমাস হয়, তাকে উপমিত কর্মধারয় সমাস বলে। যেমন: মুখ চন্দ্র সদৃশ / মুখ চন্দ্রের ন্যায় = মুখচন্দ্র। এখানে ‘চন্দ্র’ উপমান ও ‘মুখ’ উপমেয় পদ। কিন্তু মুখ ও চন্দ্রের কোন সাধারণ ধর্ম নেই। অনুরূপ-
- মুখ চন্দ্রের ন্যায় = চন্দ্রমুখ
- পুরুষ সিংহের ন্যায় = পুরুষসিংহ
- কুমারী ফুলের ন্যায় = ফুলকুমারী
- আঁখি পদ্মের ন্যায় = পদ্মআঁখী
- কর পল্লবের ন্যায় = করপল্লব (অর্থ সুন্দর হাত) ইত্যাদি। কর অর্থ হাত এবং পল্লব অর্থ গাছের নতুন পাতা।
রূপক কর্মধারয় সমাস
উপমান ও উপমেয় পদের মধ্যে অভিন্নতা কল্পনা করা হলে, তাকে রূপক কর্মধারয় সমাস বলে। এতে উপমেয় পদের পূর্বে ‘রূপ’ শব্দ যুক্ত থাকে এবং সাধারণ ধর্মের উল্লেখ থাকে না। যেমন: বিদ্যা রূপ ধন = বিদ্যাধন। এখানে ‘বিদ্যা’ ও ‘ধন’ যেন অভিন্ন এমন ভাব প্রকাশিত হয়েছে।
- প্রাণ রূপ পাখি = প্রাণপাখি
- বিষাদ রূপ সিন্ধু = বিষাদসিন্ধু
- ভব রূপ নদী = ভবনদী
- মন রূপ মাঝি = মনমাঝি
- শোক রূপ অনল = শোকানল
- হৃদয় রূপ মন্দির = হৃদয়মন্দির
- বিষ রূপ বৃক্ষ = বিষবৃক্ষ
উল্লেখ্য কখনো কখনো সর্বনাম, সংখ্যাবাচক শব্দ এবং উপসর্গ আগে বসে পরপদের সাথে কর্মধারয় সমাস গঠন করতে পারে। যেমন:
- উপসর্গ যোগে গঠিত সমাসগুলো – বিকাল (‘বি’ উপসর্গযোগে গঠিত), সকাল, বিদেশ, বেসুর ইত্যাদি।
- অব্যয়যোগে গঠিত সমাস – কুকর্ম, যথাযোগ্য;
- সর্বনামযোগে গঠিত সমাস – সেকাল, একাল;
- সংখ্যাবাচক শব্দ যোগে গঠিত সমাস – একজন, দোতালা ইত্যাদি।
দ্বিগু কর্মধারয় সমাস
৯ম-১০ম শ্রেণীর নতুন বাংলা ব্যাকরণে (২০২২) দ্বিগু সমাস নামে আলাদা কোন সমাস দেখানো হয় নি। একে কর্মধারয় সমাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
দ্বিগু শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘দুটি গরু’। কিন্তু ব্যাকরণ সম্মত অর্থ হল ‘দুটি গরুর মূল্যে কেনা’। শুরুতে সংখ্যাবাচক শব্দ থাকলে এবং সমাহার বুঝালে যে সমাস হয়, তাকে দ্বিগু কর্মধারয় সমাস বলে। মূলত সংখ্যাবাচক শব্দের সাথে বিশেষ্য পদের সমাসই দ্বিগু কর্মধারয় সমাস। সমাসনিষ্পন্ন পদটি বিশেষ্য পদ হয়। যেমন:
- পঞ্চ (পাঁচটি) গো দ্বারা ক্রীত = পঞ্চগু [এখানে গো পূর্বপদ, পঞ্চ সংখ্যাবাচক শব্দ]
- পঞ্চ হস্ত প্রমাণ ইহার = পঞ্চহস্তপ্রমাণ
- পঞ্চ বটের সমাহার = পঞ্চবটী
- চৌ রাস্তার সমাহার = চৌরাস্তা
- ত্রি (তিন) কালের সমাহার = ত্রিকাল
- সপ্ত অপের সমাহার = সপ্তাহ
- শত অব্দের সমাহার= শতাব্দী
- অষ্ট ধাতুর সমাহার = অষ্টধাতু
- তিন ভূজের সমাহার = ত্রিভুজ
- অনুরূপভাবে – চতুর্ভূজ, ত্রিমোহিনী, সাতসমুদ্র ইত্যাদি কর্মধারয় সমাস।
তৎপুরুষ সমাস
যে সমাসে পূর্বপদের বিভক্তি ও সন্নিহিত অনুসর্গ লোপ পায় এবং পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায়, তাকে তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন: লবণ দ্বারা অক্ত (যুক্ত) = লবণাক্ত; এখানে পূর্বপদের (লবণ) সন্নিহিত অনুসর্গ ‘দ্বারা’ লোপ পেয়েছে এবং পরপদের (অক্ত) অর্থ প্রাধান্য পাচ্ছে। “তৎপুরুষ” শব্দটির অর্থ হল “তার পুরুষ”; ‘তার’, ‘পুরুষ’ – শব্দগুলির একপদীকরণে ‘তৎপুরুষ’ শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে। একইভাবে তৎপুরুষ সমাসের অধিকাংশ উদাহরণে পূর্বপদের বিভক্তি লোপ পায় ও পরপদের অর্থের প্রাধান্য থাকে। তৎপুরুষ শব্দটি এই রীতিতে নিষ্পন্ন সমাসের একটি বিশিষ্ট উদাহরণ। তাই উদাহরণের নামেই এর সাধারণ নামকরণ করা হয়েছে তৎপুরুষ সমাস। তৎপুরুষ সমাসের আরও উদাহরণ –
- নিম রূপে/ভাবে রাজি = নিমরাজি
- অন্ধ করে যে = অন্ধকার
- বিয়ের জন্য পাগলা = বিয়ে পাগলা
- স্নাতক হতে উত্তর = স্নাতকোত্তর
- গোলায় ভরা = গোলাভরা
- দৃঢ় ভাবে বদ্ধ = দৃঢ়বদ্ধ ইত্যাদি।
বিভক্তি সম্পর্কিত তথ্য
তৎপুরুষ সমাস বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। যথা:-
দ্বিতীয়া-তৎপুরুষ
পূর্বপদে দ্বিতীয়া-বিভক্তি লোপ পেয়ে যে সমাস, তাকে দ্বিতীয়া-তৎপুরুষ বলে। যেমন: স্বর্গকে/স্বর্গে গত = স্বর্গগত। এ সমাসে সাধারণত কে, রে, ব্যাপিয়া ইত্যাদি লোপ পায়। আরও উদাহরণ-
বইকে পড়া = বইপড়া |
বিস্ময়কে আপন্ন = বিস্ময়াপন্ন |
বিপদকে আপন্ন = বিপদাপন্ন |
আমকে কুড়ানো = আমকুড়ানো |
দেবকে দত্ত = দেবদত্ত |
গাকে ঢাকা = গা-ঢাকা |
ছেলেকে ভুলানো = ছেলে-ভুলানো |
দুঃখকে অতীত = দুঃখাতীত |
রথকে দেখা = রথদেখা |
তৃতীয়া-তৎপুরুষ
পূর্বপদে তৃতীয়া-বিভক্তি লোপ পেয়ে যে সমাস, তাকে তৃতীয়া-তৎপুরুষ বলে। যেমন: রজ্জু(দড়ি) দ্বারা বন্ধ = রজ্জুবন্ধ। তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাসে সাধারণত ব্যাসবাক্যের দ্বারা, দিয়ে, কর্তৃক ইত্যাদি লোপ পায়। উদাহরণ-
মন দিয়ে গড়া = মনগড়া |
মধু দিয়ে মাখা = মধুমাখা |
চিনি দিয়ে পাতা = চিনিপাতা |
শ্রম দ্বারা লব্ধ = শ্রমলব্ধ |
ধনে আঢ্য(সমৃদ্ধ) = ধনাঢ্য |
বাক্ দ্বারা বিতণ্ডা = বাকবিতণ্ডা |
হীরক দ্বারা খচিত = হীরকখচিত |
চন্দন দ্বারা চর্চিত = চন্দনচর্চিত |
স্বর্ণ দ্বারা মণ্ডিত = স্বর্ণমণ্ডিত |
রত্ন দ্বারা শোভিত = রত্নশোভিত |
মেঘ দ্বারা শূন্য = মেঘশূন্য |
বাক্(কথা) দ্বারা দত্তা = বাগদত্তা |
বিদ্যা দ্বারা হীন(শূন্য) = বিদ্যাহীন |
এক দ্বারা ঊন(কম) = একোন(এক কম এমন) |
জ্ঞান দ্বারা শূন্য = জ্ঞানশূন্য |
পাঁচ দ্বারা কম = পাঁচকম |
অলুক তৃতীয় তৎপুরুষ: তৎপুরুষ সমাসে তৃতীয়া বিভক্তি লোপ না পেলে সে সমাসকে অলুক তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাস বলে।
তেলে ভাজা = তেলেভাজা |
কলে ছাঁটা = কলেছাটা |
তাঁতে বোনা = তাঁতেবোনা |
পোকায় কাটা = পোকায়কাটা |
চতুর্থী-তৎপুরুষ
পূর্বপদে চতুর্থী-বিভক্তি লোপ পেয়ে যে সমাস, তাকে চতুর্থী-তৎপুরুষ বলে। যেমন: যজ্ঞের নিমিত্ত ভূমি = যজ্ঞভূমি। চতুর্থী তৎপুরুষ সমাসে সাধারণত ব্যাসবাক্যের কে, জন্য, নিমিত্ত ইত্যাদি লোপ পায়। উদাহরণ-
গুরুকে ভক্তি = গুরুভক্তি |
হজ্জের নিমিত্ত যাত্রা = হজ্জযাত্রা |
তপের(সাধনার) নিমিত্ত বন = তপোবন (আশ্রম) |
রান্নার নিমিত্তে ঘর = রান্নাঘর |
ছাত্রের জন্য আবাস = ছাত্রাবাস |
চোষের জন্য কাগজ = চোষকাগজ |
ডাকের জন্য মাসুল = ডাকমাসুল |
মুসাফিরের জন্য খানা = মুসাফিরখানা |
মালের জন্য গুদাম = মালগুদাম |
মাপের জন্য কাঠি = মাপকাঠি |
পঞ্চমী-তৎপুরুষ
পূর্বপদে পঞ্চমী-বিভক্তি লোপ পেয়ে যে সমাস, তাকে পঞ্চমী-তৎপুরুষ বলে। যেমন: মুখ হইতে ভ্রষ্ট = মুখভ্রষ্ট। পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাসে সাধারণত ব্যাসবাক্যের হইতে, থেকে, চেয়ে ইত্যাদি লোপ পায়। উদাহরণ-
ইতি হতে আদি = ইত্যাদি | স্কুল থেকে পালানো = স্কুলপালানো |
পরানের চেয়ে প্রিয় = পরানপ্রিয় | জেল থেকে মুক্ত = জেলমুক্ত |
আগা থেকে গোড়া = আগাগোড়া | জেল থেকে খালাস = জেলখালাস |
ঋণ থেকে মুক্ত = ঋণমুক্ত | গ্রাম থেকে ছাড়া = গ্রামছাড়া |
ষষ্ঠী-তৎপুরুষ
পূর্বপদে ষষ্ঠী-বিভক্তি লোপ পেয়ে যে সমাস, তাকে ষষ্ঠী-তৎপুরুষ বলে। যেমন: দীনের বন্ধু = দীনবন্ধু। ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাসে সাধারণত ব্যাসবাক্যের র, এর লোপ পায়। উদাহরণ-
বিশ্বের কবি = বিশ্বকবি | অহ্নের পূর্ব = পূর্বাহ্ন |
চন্দ্রের অর্ধ = অর্ধচন্দ্র | হস্তীর যূথ = হস্তীযূথ |
হাঁসের রাজা = রাজহাঁস | দিনের অর্ধ = অর্ধদিন |
দেশের সেবা = দেশসেবা | পথের রাজা = রাজপথ |
সপ্তমী-তৎপুরুষ
পূর্বপদে সপ্তমী-বিভক্তি লোপ পেয়ে যে সমাস, তাকে সপ্তমী-তৎপুরুষ বলে। যেমন: দিবাতে নিদ্রা = দিবানিদ্রা। সপ্তমী তৎপুরুষ সমাসে সাধারণত ব্যাসবাক্যের এ, য়, তে বিভক্তি লোপ পায়। উদাহরণ-
গাছে পাকা = গাছপাকা | অনুরূপ- বাকপটু, গোলাভরা, বিশ্ববিখ্যাত, রাতকানা ইত্যাদি |
পূর্বে ভূত = ভূতপূর্ব | |
পূর্ব অদৃষ্ট = অদৃষ্টপূর্ব | |
দিবায় নিদ্রা = দিবানিদ্রা |
নঞ তৎপুরুষ
নঞ্ অব্যয় বা না বাচক অব্যয় পূর্বে থেকে যে তৎপুরুষ সমাস হয়, তাকে নঞ তৎপুরুষ বলে। যেমন:
- নয়-কাতর = অকাতর
- নয় কাঁড়া = আকাঁড়া
- নয় ধর্ম = অধর্ম
- নয় উচিত = অনুচিত
- নয় পর্যাপ্ত = অপর্যাপ্ত
- নয় এক = অনেক
- নয় হাজির = গরহাজির
- ন অতিশীতোষ্ণ = নাতিশীতোষ্ণ
- ন-আচার = অনাচার
- ন গাছ = আগাছা
- ন উক্ত = অনুক্ত
- ন বিশ্বাস = অবিশ্বাস
- ন অতি দীর্ঘ = নাতিদীর্ঘ
- ন অতি খর্ব = নাতিখর্ব
- ন মঞ্জুর = নামঞ্জুর
- ন বালক = নাবালক
- ন মানুষ = অমানুষ
- ন ভাব = অভাব
- ন সঙ্গত = অসঙ্গত
- ন অন্য = অনন্য
- ন চেনা = অচেনা
- নাই মিল = গরমিল
- নাই হুঁশ = বেহুঁশ
- বে আইনি = বেআইনি
উপপদ তৎপুরুষ
কৃদন্ত-পদের পূর্বে যে পদ থাকে, তাকে উপপদ বলে এবং উপপদের সাথে কৃদন্ত-পদের যে সমাস হয়, তাকে উপপদ সমাস বলে। যেমন:
- পঙ্কে জন্মে যা = পঙ্কজ
- জলে জন্মে যা = জলজ
- জল দেয় যা = জলদ
- খ তে চরে যা = খেচর
- পকেট মারে যে = পকেটমার
- সত্য কথা বলে যে = সত্যবাদী
- বর্ণ চুরি করে যে = বর্ণচোরা
- ছ-পোষে যে = ছা-পোষা
- বেতন ভোগ করে যে = বেতনভোগী
- ঘর পুড়েছে যার = ঘরপোড়া
- মধু পান করে যে = মধুপ
- হরেক রকম বলে যে = হরবোলা
- হাড় ভাঙ্গে যাতে = হাড়ভাঙ্গা
- ইন্দ্রকে জয় করে যে = ইন্দ্রজিৎ
- ক্ষীণভাবে বাঁচে যে = ক্ষীণজীবী
- একান্নে বর্তে যে = একান্নবর্তী
- মনে মরেছে যে = মনমরা
- অর্থ করা যায় যার দ্বারা = অর্থকারী ইত্যাদি
অলুক তৎপুরুষ
যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্ব পদের দ্বিতীয়াদি বিভক্তি লোপ হয় না তাকে অলুক তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন: ঘিয়ে ভাজা, গরুর গাড়ি, গায়েপড়া ইত্যাদি।
বহুব্রীহি সমাস
যে সমাসের সমস্তপদে পূর্বপদ ও পরপদের অর্থ না বুঝিয়ে অন্য কোন পদকে বোঝায় তাকে বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন: বহু ব্রীহি (ধান) আছে যার = বহুব্রীহি। এখানে ‘বহুব্রীহি’ দ্বারা ‘বহু’ কিংবা ‘ব্রীহি’ কোনটির অর্থ প্রধানভাবে না বুঝিয়ে দুটি শব্দ সমষ্টিগতভাবে বহু ধান আছে এমন ব্যক্তিকে বোঝাচ্ছে।
আরও কিছু উদাহরণ-
আয়ত লোচন যার = আয়তলোচনা |
মহান আত্মা যার = মহাত্মা |
স্বচ্ছ সলিল যার = স্বচ্চসলিলা |
স্থির প্রতিজ্ঞা যার = স্থির প্রতিজ্ঞ |
‘সহ’ কিংবা ‘সহিত’ শব্দের সাথে অন্য বহুব্রীহি সমাস হলে ‘সহ’ কিংবা ‘সহিত’ এর স্থলে ‘স’ হয়। যেমন: বান্ধবসহ বর্তমান = সবান্ধব। অনুরূপ-
সহ উদর যার = সহোদর > সোদর |
জলের সঙ্গে বর্তমান = সজল |
ফলের সহিত বর্তমান = সফল |
দর্পের সঙ্গে বর্তমান = সদর্প |
পরপদে মাতৃ, পিতৃ, পুত্র, স্ত্রী ইত্যাদি শব্দ থাকলে এ শব্দগুলোর সাথে ‘ক’ যুক্ত হয়। যেমন: নদী মাতা যার = নদীমাতৃক। অনুরূপ-
বি(গত) হয়েছে পত্নী যার = বিপত্নীক |
স্ত্রীর সহিত বর্তমান = সস্ত্রীক |
পুত্রের সহিত বর্তমান = সপুত্রক |
বহুব্রীহি সমাসে-
- পরপদের ‘জয়া’ শব্দের স্থানে ‘জানি’ হয়। যেমন: যুবতী জয়া যার = যুবজানী।
- পরপদের ‘চূড়া’ শব্দে স্থানে ‘চূড়’ হয়। যেমন: চন্দ্র চুড়া যার = চন্দ্রচূড়।
- পরপদের ‘কর্ম’ শব্দে স্থানে ‘কর্মা’ হয়। যেমন: বিচিত্র কর্ম যার = বিচিত্রকর্মা।
- ‘সমান’ শব্দের স্থানে ‘স’ এবং ‘সহ’ হয়। যেমন: সমান কর্মী যে = সহকর্মী; সমান র্বণ যার = সমবর্ণ, সমান উদর যাদের = সহদর।
- পরপদের ‘গান্ধ’ শব্দে স্থানে ‘গান্ধি’ বা ‘গান্ধা’ হয়। যেমন: সুগন্ধ যার = সুগন্ধি।
বহুব্রীহি সমাস ৮ প্রকার। যথা:
সমানাধিকরণ বহুব্রীহি
পূর্বপদ বিশেষণ এবং পরপদে বিশেষ্য থাকলে যে বহুব্রীহি সমাস হয় তাকে সমানাধিকরণ বহুব্রীহি বলে। যেমন: হত হয়েছে শ্রী যার= হতশ্রী। অনুরূপভাবে –
- হৃত হয়েছে সর্বস্ব যার = হৃতসর্বস্ব
- খোশ মেজাজ যার = খোশমেজাজ
- উচ্চ শির যার = উচ্চশির
- পীত অম্বর যার = পীতাম্বর
- এক গোঁ যার = একগুঁয়ে
- নীল কণ্ঠ যার = নীলকণ্ঠ
- জবর দস্ত যার = জবরদস্তি
- সু শীল যার = সুশীল
- নতুন ধানের অন্ন = নবান্ন
- সু শ্রী যার = সুশ্রী ইত্যাদি।
উল্লেখ্য মহানবী (মহান যে নবী) ও মহাজন (মহান যে জন) কর্মধারয় সমাস। কিন্তু মহাত্না (মহান আত্মা যার) বহুব্রীহি সমাস। অধ্যাত্ম (আত্মাকে অধি) অব্যয়ীভাব সমাস। নবান্ন, নীলপদ্ম মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস। কিন্তু নবরত্ন (নব রত্নের সমাহার) দ্বিগু সমাস ও নীলকণ্ঠ (নীল কণ্ঠ যার) সমানাধিকরণ বহুব্রীহি সমাস।
ব্যাধিকরণ বহুব্রীহি
যে বহুব্রীহি সমাসের পূর্বপদ এবং পরপদ কোনোটিই বিশেষণ পদ না, তাকে ব্যাধিকরণ বহুব্রীহি বলে। যেমন: কথা সর্বস্ব যার = কথাসর্বস্ব। পরপদ কৃদন্ত বিশেষণ হলেও ব্যাধিকরণ বহুব্রীহি সমাস হয়। যেমন: দুই কান কাটা যার= দু কানকাটা, বোঁটা খসেছে যার= বোঁটাখসা। অনুরূপভাবে-
- আশীতে (দাঁতে) বিষ যার = আশীবিষ
- ছা পুষেছে যে = ছা-পোষা
- পা চাটে যে = পা-চাটা,
- পাতা চাটে যে = পাতা-চাটা,
- পাতা ছেঁড়ে যে = পাতাছেঁড়া,
- ধামা ধরে যে = ধামাধরা ইত্যাদি।
পদলোপী বহুব্রীহি
যে বহুব্রীহি সমাসের ব্যাখ্যার জন্য ব্যবহৃত বাক্যাংশের কোনো অংশ সমস্তপদে লোপ পায়, তাকে পদলোপী বহুব্রীহি বলে। যেমন:
- গোঁফে খেজুর পড়ে থালেও খায় না যে = গোঁফ-খেজুরে
- হাতে খড়ি দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে = হাতেখড়ি
- গায়ে হলুদ দেয়া হয় যে অনুষ্ঠানে = গায়ে হলুদ
- মেনির ন্যায় মুখ যার = মেনিমুখো
- জন্ম হয়েছে অষ্টমীর দিনে যার = জন্মাষ্টমী
- সোনার ন্যায়মূল্যপূর্ন অক্ষি যার = সোনাক্ষি
- বিড়ালের চোখের ন্যায় চোখ যে নারীর = বিড়ালচোখী
- বিড়ালের মতো অক্ষি যার = বিড়ালাক্ষী
- রুদ্র রূপ হইতে অক্ষি যার = রুদ্রাক্ষী
ব্যাতিহার বহুব্রীহি
ক্রিয়ার পারস্পরিক অর্থে ব্যতিহার বহুব্রীহি হয়। অর্থ্যাৎ একই রূপ দুটি বিশেষ্য পদ একসাথে বসে পরস্পর একই জাতীয় কাজ করে। এ সমাসে পূর্বপদে ‘আ’ এবং পরপদে ‘ই’ যুক্ত হয়। যেমন:
- হাতে হাতে যে যুদ্ধ = হাতাহাতি
- কানে কানে যে কথা = কানাকানি
- অনুরূপ – চুলাচুলি, কাড়াকাড়ি, গালাগালি, দেখাদেখি, কোলাকুলি ইত্যাদি।
অলুক বহুব্রীহি
যে বহুব্রীহি সমাসে পূর্ব বা পরপদের কোনো পরিবর্তন হয় না, তাকে অলুক বহুব্রীহি বলে। এতে সমস্ত পদটি বিশেষণ হয়। যেমন:
- মাথায় পাগড়ি যার = মাথায়পাগড়ি
- গলায় গামছা যার = গলায়গামছা
- গায়ে এসে পড়ে যে = গায়ে-পড়া
- কানে খাটো যে = কানে-খাটো
- এরূপ: হাতে-ছড়ি, কানে-কলম, মুখে-ভাত ইত্যাদি।
নঞ্ বহুব্রীহি
বিশেষ্য পূর্বপদের আগে নঞ্ বা না অর্থবোধক অব্যয় যোগ করে যে বহুব্রীহি সমাস করা হয় তাকে নঞ্ বহুব্রীহি বলে। এতে সাধিত পদটি বিশেষণ হয়। যেমন:
- ন (নাই) জ্ঞান যার= অজ্ঞান
- না (নাই) চারা (উপায়) যার= নাচার
- নি (নাই) ভুল যার= নির্ভুল,
- না (নয়) জানা যা= নাজানা/অজানা
- অনুরূপ- নির্ঝঞ্ঝাট, নিরুপায়, নাহক, অবুঝ, অকেজো, অনন্ত, বে-পরোয়া, বেঁহুশ, বেতার ইত্যাদি।
নঞ তৎপুরুষ, নঞ বহুব্রীহি ও অব্যয়ীভাব সমাসের মধ্যে পার্থক্য
কোন শব্দ কোন সমাসের অন্তর্ভুক্ত হবে তা ব্যাসবাক্যের উপর নির্ভর করে। আবার একই শব্দের একাধিক ব্যাসবাক্য করা সম্ভব। ফলে একই শব্দ শুধুমাত্র ব্যাসবাক্য কিভাবে করা হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে নঞ তৎপুরুষ, নঞ বহুব্রীহি বা অব্যয়ীভাব সমাস হতে পারে। যেমন:
- নয় ওয়ারিশ = বেওয়ারিশ (নঞ তৎপুরুষ)
- ওয়ারিশ নাই যার = বেওয়ারিশ (নঞ বহুব্রীহি)
- ওয়ারিশের অভাব = বেওয়ারিশ (অব্যয়ীভাব)
সাধারণত ব্যাসবাক্যের শুরুতে ন, নাই এবং শেষে যে/যার/যা থাকলে সেটি নঞ বহুব্রীহি সমাস হয়।
- ন (নাই) জানা = অজানা (নঞ তৎপুরুষ)
- নাই জানা যা = অজানা (নঞ বহুব্রীহি)
প্রত্যয়ান্ত বহুব্রীহি
যে বহুব্রীহি সমাসের সমস্তপদে আ, এ, ও ইত্যাদি প্রত্যয় যুক্ত হয় তাকে প্রত্যয়ান্ত বহুব্রীহি বলা হয়। যেমন:
- এক দিকে চোখ (দৃষ্টি) যার = একচোখা
- ঘরের দিকে মুখ যার = ঘরমুখো
- নিঃ (নেই) খরচ যার = নি-খরচে
- তিন (তে) ভাগ যার = তেভাগা
- অনুরূপ- অকেজো, একগুঁয়ে, একঘরে, ঊনপাঁজুরে, দোটানা, দোতলা ইত্যাদি।
সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি
পূর্বপদ সংখ্যাবাচক এবং পরপদ বিশেষ্য পদ থাকলে এবং সমস্তপদটি বিশেষণ বোঝালে তাকে সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি বলা হয়। এ সমাসে সমস্তপদে ‘আ’, ‘ই’ বা ‘ঈ’ যুক্ত হয়। যেমন:
- চৌ (চার) চাল যে ঘরের = চৌচালা
- চার হাত পরিমাণ যার = চারহাতি
- তে (তিন) পা যার = তেপায়া ইত্যাদি।
- ব্যতিক্রম, সে (তিন) তার (যে যন্ত্রের) = সেতার (বিশেষ্য)।
নিপাতনে সিদ্ধ বহুব্রীহি
যে বহুব্রীহি সমাস কোন নিয়মের অধীনে নয়। যেমন:
- দু দিকে অপ (জল বা পানি) যার = দ্বীপ
- অন্তর্গত অপ যার = অন্তরীপ
- নরাকারের পশু যে = নরপশু
- জীবিত থেকেও যে মৃত = জীবন্মৃত
- পণ্ডিত হয়েও যে মূর্খ = পণ্ডিতমূর্খ
অব্যয়ীভাব সমাস
৯ম-১০ম শ্রেণীর নতুন বাংলা ব্যাকরণে (২০২২) দ্বিগু নামে কোন সমাস দেখানো হয় নি। পুরাতন ব্যাকরণ বই থেকে নিম্নোক্ত অংশ নেওয়া।
অব্যয় পদ পূর্বে থেকে যে সমাস হয় এবং যাতে পূর্বপদের অর্থেরই প্রাধান্য থাকে, তাকে অব্যয়ীভাব সমাস বলে। এই সমাসকে বর্তমানে উপসর্গ তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন: আত্মাকে অধি (অধিকার করিয়া) = অধ্যাত্ম। উল্লেখ্য উপসর্গকে অব্যয়জাত শব্দাংশ বলে। অব্যয়ীভাব সমাসের সমস্ত পদে প্রথমে উপসর্গ থাকে। সামীপ্য, বিপ্সা, পর্যন্ত, অভাব প্রভৃতি অর্থে অব্যয়ীভাব সমাস হয়। যেমন –
অব্যয় | অব্যয়ের অর্থ | উদাহরণ |
---|---|---|
অনু | পশ্চাৎ | পশ্চাৎ গমন = অনুগমন পশ্চাৎ ধাবন = অনুধাবন |
অনু | বিপসা (পৌনঃপুনিকতা) | ক্ষণ ক্ষণ = অনুক্ষণ |
আ | পর্যন্ত | সমুদ্র থেকে হিমাচল পর্যন্ত = আসমুদ্রহিমাচল পা থেকে মাথা পর্যন্ত = আপাদমস্তক |
আ | ঈষৎ | ঈষৎ নত = আনত ঈষৎ রক্তিম = আরক্তিম |
উপ | সামীপ্য | কণ্ঠের সমীপে = উপকণ্ঠ কূলের সমীপে = উপকূল |
উপ | সাদৃশ্য | শহরের সাদৃশ = উপশহর গ্রহের তুল্য = উপগ্রহ বনের সাদৃশ = উপবন বৃত্তির সাদৃশ = উপবৃত্তি |
উপ | ক্ষুদ্র | ক্ষুদ্র গ্রহ = উপগ্রহ ক্ষুদ্র নদী = উপনদী |
উৎ | অতিক্রান্ত | বেলাকে অতিক্রান্ত = উদ্বেল শৃঙ্খলাকে অতিক্রান্ত = উচ্ছৃঙ্খল |
প্র, পর | দূরবর্তী | অক্ষির অগোচরে = পরোক্ষ পিতামহের পূর্বে/দূরবর্তীতে = প্রপিতামহ |
প্রতি | বিপসা | দিন দিন = প্রতিদিন ক্ষণে ক্ষণে = প্রতিক্ষণে |
প্রতি | বিরোধ | বিরুদ্ধ বাদ = প্রতিবাদ বিরুদ্ধ কূল = প্রতিকূল |
প্রতি | প্রতিনিধি | ছায়ার প্রতি = প্রতিচ্ছায়া ছবির প্রতিনিধি = প্রতিচ্ছবি বিম্বের প্রতিনিধি = প্রতিবিম্ব |
প্রতি | প্রতিদ্বন্দী | পক্ষের বিপরীত/বিরুদ্ধে= প্রতিপক্ষ উত্তরের বিপরীত = প্রত্যুত্তর |
পরি | পূর্ণ/সমগ্র | পরিপূর্ণ, সম্পূর্ণ |
নিঃ বা নির | অভাব | আমিষের অভাব = নিরামিষ ভাবনার অভাব = নির্ভাবনা জলের অভাব = নির্জল উৎসাহের অভাব = নিরুৎসাহ |
যথা | অনতিক্রম্যতা | রীতিকে অতিক্রম না করে = যথারীতি সাধ্যকে অতিক্রম না করে = যথাসাধ্য বিধিকে অতিক্রম না করে = যথাবিধি যোগ্যকে অতিক্রম না করে = যথাযোগ্য |
অন্যান্য সমাস
ছয়টি প্রধান সমাস ছাড়াও কয়েকটি অপ্রধান সমাস রয়েছে। যেমন: প্রাদি, নিত্য, অলুক, উপপদ ইত্যাদি। এসব সমাসের প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যায় না। এজন্য এগুলোকে অপ্রধান মনে করা হয়।
নিত্য সমাস
যে সমাসে সমস্যমান পদ দ্বারা সমাস-বাক্য হয় না, অন্য পদের দ্বারা সমস্ত পদের অর্থ প্রকাশ করতে হয়, তাকে নিত্য সমাস বলে। অর্থবাচক ব্যাখ্যামূলক শব্দ বা বাক্যাংশ যোগে এগুলোর অর্থ বিশদ করতে হয়। যেমন: কেবল তা = তন্মাত্র, অন্য গ্রাম = গ্রামান্তর, কেবল দর্শন = দর্শনমাত্র, অন্য গৃহ = গৃহান্তর, (বিষাক্ত) কাল (যম) তুল্য (কাল বর্ণের নয়) সাপ = কালসাপ, তুমি আমি ও সে = আমরা, দুই এবং নব্বই = বিরানব্বই।
প্রাদি সমাস
প্র, পরা প্রভৃতি ২০টি উপসর্গের সাথে কৃৎ প্রত্যয়সাধিত বিশেষ্য পদের সমাস হলে, তাকে প্রাদি সমাস বলে। যেমন:
- সম্ (সম্যক্) যে আদর = সমাদর
- প্র (প্রকৃষ্ট) যে বচন = প্রবচন
- পরি (চতুর্দিকে) যে ভ্রমণ = পরিভ্রমণ
- অনুতে (পশ্চাতে) যে তাপ = অনুতাপ
- প্র (প্রকৃষ্ট রূপে) ভাত (আলোকিত) = প্রভাত
- প্র (প্রকৃষ্ট রূপে) গতি = প্রগতি
- প্রকৃত রুপে দর্শন = প্রদর্শন
- প্রত্যয় দ্বারা নাম = প্রনাম
বাক্যাশ্রয়ী সমাস
যে সমাসে সমাসবদ্ধ পদগুলি একমাত্রায় লেখা হয় না এমনকি সবসময় পদসংযোজক চিহ্ন দ্বারাও যুক্ত করে লেখা হয় না – বিচ্ছিন্নভাবে লিখিত এই সমাসকে বলা হয় বাক্যাশ্রয়ী সমাস। যেমন: ‘বসে আঁকো প্রতিযোগিতা’, ‘সব পেয়েছির দেশ’ ইত্যাদি ।
আরও পোস্ট