স্নায়ুযুদ্ধ

Estimated Reading Time: 38 Minutes

স্নায়ুযুদ্ধ বা Cold War হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্রদের মধ্যকার টানাপোড়েনের নাম। ১৯৪৫ সালে থেকে ১৯৯১ সালে পর্যন্ত তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধে না গিয়েও নিজস্ব অর্থনৈতিক ও অন্যান্য প্রভাব ব্যবহার করে যে সংঘাত তাই ইতিহাসে স্নায়ুযুদ্ধ নামে পরিচিত। স্নায়ুযুদ্ধ মূলত দুটি শক্তিধর দেশের আদর্শগত দ্বন্দ্ব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো ছিল গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদের স্বপক্ষে; অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্রদেশগুলো ছিল সাম্যবাদী বা সমাজতন্ত্রপন্থী। ফলে এই দুই শক্তির আদর্শিক দ্বন্দ্ব থেকে সৃষ্ট পৃথিবীব্যাপী (বিশেষত ইউরোপে) প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগীতা থেকেই স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হয়। মার্কিন সাংবাদিক ওয়াল্টার লিপম্যান তার দ্য কোল্ড ওয়ার গ্রন্থে ‘স্নায়ুযুদ্ধ’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন।

যুক্তরাষ্ট্র জোটসোভিয়েত ইউনিয়ন জোট
যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, জাপান ও কানাডাবুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, পূর্ব জার্মানি ও রোমানিয়া
প্রধান প্রধান মিত্র
স্নায়ুযুদ্ধে সময় ইউরোপ

ট্রুম্যান নীতির মাধ্যমে স্নায়ুযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ মালটা কনফারেন্সের মাধ্যমে স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি নির্দেশ করেন। তবে প্রকৃতপক্ষে স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয় ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে।

বিরোধের সূত্রপাত

১৯৪১ সালে আটলান্টিক সনদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট জোসেফ স্ট্যালিনকে আমন্ত্রণ জানাননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দুই দেশ একসাথে লড়াই করলেও যুদ্ধের পর এ দুই দেশের আদর্শিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালায়। অপরদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হওয়া যুক্তরাষ্ট্র নিজের অর্থনৈতিক সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে নিজ প্রভাব বিস্তার ও সোভিয়েত প্রভাব খর্ব করার চেষ্টা চালালে তা বিশ্বব্যাপী স্নায়ুযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়।

স্নায়ুযুদ্ধের সময়কালীন নীতি

ট্রুম্যান নীতি

১৯৪৭ সালের ১২ মার্চ মার্কিন কংগ্রেসে প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান যে পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণা করেন তাই ট্রুম্যান নীতি নামে পরিচিত। এসময় ট্রুম্যান আনুষ্ঠানিকভাবে Cold war শব্দটি ব্যবহার করেন। এ নীতির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র –

  • সমাজতন্ত্রের বিস্তার রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
  • কোন দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব অনুষ্ঠিত হলে যুক্তরাষ্ট্র বিপ্লবীদের বিরুদ্ধের সরকারকে সমর্থন করার নীতি গ্রহণ করে।
  • গ্রীস এবং তুরস্ককে সাহায্য করার জন্য আর্থিক মঞ্জুরী ঘোষণা করে।

মার্শাল প্লান

ট্রুম্যান নীতি বাস্তবায়ন করার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জ সি মার্শাল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় যে পরিকল্পনার রূপরেখা তুলে ধরেন তাই মার্শাল প্লান নামে পরিচিত। এটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় পুণর্গঠন প্রকল্প নামে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় দেশগুলোর বিধ্বস্ত অর্থনৈতির পুনর্গঠন এবং সেখানে সোভিয়েত কমিউনিজমের বিস্তার রোধ করার লক্ষ্যে এ পরিকল্পনা অনুসারে যুক্তরাষ্ট্র ঐসব দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

Molotov Plan

তৎকালীন কোন কমিউনিস্ট দেশই মার্শাল প্লানকে স্বাগত জানায়নি। বরং মার্শাল প্লানের বিপরীতে ঐ বছরই (১৯৪৭) সোভিয়েত ইউনিয়ন Molotov Plan গ্রহণ করে। সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভাইচেস্লাভ মলোটভ এ পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহযোগীতার বিপরীতে এ পরিকল্পনার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোকে আর্থিক সহযোগীতা প্রদান করে।

  • ঘোষণা: ১৯৪৭
  • ঘোষণা করেন: সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভাইস্লোভ মলোটভ।
  • উদ্দেশ্য: পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশ গুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান।

গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রৈকা

সোভিয়েত খোলানীতি নামে পরিচিত। স্নায়ুযুদ্ধের শেষের দিকে ১৯৮৭ সালে সাবেক সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ এ নীতি প্রবর্তন করেন। মত প্রকাশের খোলা নীতি হল গ্লাসনস্ত এবং পূর্ণগঠন ও সংস্কার প্রশ্নে নেয়া উদারনৈতিক বা মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রচলন নীতি হল পেরেস্ত্রৈকা। গর্বাচেভের এ নীতি ব্যর্থ হওয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায়।

অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ

COMINFORM

Information Bureau of the Communist and Workers’ Parties

১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটি ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সংগঠন ছিল। এটি ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর জোট ছিল। মূলত ইউরোপীয় দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহযোগিতা নেওয়া থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে এ জোট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

COMECON

Council for Mutual Economic Assistance

এটি ১৯৪৯ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন একটি অর্থনৈতিক সংগঠন যা বিশ্বের বেশ কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক দেশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল। এর সদর দপ্তর ছিল বর্তমান রাশিয়ার মস্কোয়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতনের সাথে সাথে এ সংস্থাটিও বিলুপ্ত হয়।

  • প্রতিষ্ঠা: ১৯৪৯
  • পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর অর্থনৈতিক জোট।
  • সদস্য দেশ: Albania, Bulgaria, Czechoslovakia, Cuba, East Germany, Hungary, Mongolia, Poland, Romania, Soviet Union, Vietnam
  • বিলুপ্ত: ১৯৯১

European Coal and Steel Community

১৯৫১ সালে কয়লা ও ইস্পাত শিল্প নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তথা শিল্পজাত পণ্য কেন্দ্রীকরণের উদ্দেশ্য ইউরোপের ৬টি দেশ: ফ্রান্স, ইতালি, পশ্চিম জার্মানি, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড ও লুমেক্সেবার্গ প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করে। মূলত ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাথমিক যাত্রা শুরু হয়েছিল এ সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই।

EEC

European Economic Community

১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউরোপের একটি আঞ্চলিক সংগঠন। মূলত ইউরোপের তৎকালীন পুঁজিবাদী দেশগুলো এর সদস্য ছিল। ১৯৫৭ সালের রোম চুক্তির অধীনে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক একীকরণ ছিল এ সংস্থার লক্ষ্যে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের পর সংস্থাটি ১৯৯৩ সালে European Community নাম ধারণ করে। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে সংস্থাটি পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়।

প্রতিরক্ষা চুক্তি

ডানকার্ক চুক্তি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সম্ভাব্য জার্মান আক্রমণের বিরুদ্ধে জোট এবং পারস্পরিক সহায়তার চুক্তি হিসেবে ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যে ফ্রান্সের ডানকার্কে ১৯৪৭ সালে ডানকার্ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তবে জার্মান হুমকির আড়ালে মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্যই দেশ দুটি এ চুক্তি সম্পন্ন করেছিল।

  • স্বাক্ষর: ১৯৪৭
  • স্বাক্ষরকারী: বৃটেন ও ফ্রান্স
  • এ চুক্তির মাধ্যমে উক্ত দুই দেশ সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে হুমকি হিসেবে দেখে।

ব্রাসেলস চুক্তি

১৯৪৮ সালে বেলজিয়ামের ব্রসেলসে স্বাক্ষরিত অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা এবং যৌথ আত্মরক্ষার চুক্তি। এটি মূলত ডানকার্ক চুক্তিরই সম্প্রসারিত রূপ।

  • স্বাক্ষর: ১৯৪৭
  • স্বাক্ষরকারী: ৫ টি দেশ – বৃটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড ও লুক্সেমবার্গ
  • ফলাফল: NATO সহ বিভিন্ন ইউরোপীয় অর্থনৈতিক ও সামরিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা।

অস্ত্র চুক্তি

স্নায়ুযুদ্ধে উত্তেজনা কমাতে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেদের মধ্যে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি করেছিল। কিছু উল্লেখযোগ্য অস্ত্র চুক্তি –

চুক্তির নামস্বাক্ষরবিষয়বস্তুতথ্য
Anti Ballistic Missile Treaty (ABM)১৯৭২পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম ব্যালাস্টিক মিসাইল নিয়ন্ত্রণ চুক্তি২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়।
Strategic Arms Limitation Talks (SALT)১৯৭৪ (SALT-1) ও
১৯৭৯ ( SALT-2)
অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি।আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট SALT-2 অনুমোদন দেয় নি।
Strategic Arms Reduction Treaty (SART)১৯৯১ (START-1)

১৯৯৩ (START- 2)
কৌশলগত অস্ত্রহ্রাস সংক্রান্ত চুক্তি

সামরিক জোটসমূহ

NATO

North Atlantic Treaty Organization

১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সামরিক জোট। এ জোটভুক্ত দেশগুলোর পারস্পরকে সামরিক সহযোগিতা প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ। অর্থ্যাৎ এক দেশ আক্রান্ত হলে সকল দেশ মিলে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এ সংস্থার সদস্য দেশগুলো প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

NATO এর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিল ১২টি। বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৩০, যার মধ্যে ইউরোপীয় দেশ ২৮টি ও উত্তর আমেরিকার দেশ ২টি: যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা। ন্যাটোর সদর দপ্তর বেলজিয়ামের ব্রসেলসে অবস্থিত। এর দাপ্তরিক ভাষা ইংরেজি ও ফরাসি। উল্লেখ্য ন্যাটো বাহিনী ২০০৩ সালে আফগানিস্তানে International Security Assistance Force (ISAF) মিশনে অংশগ্রহণ করে যা ইউরোপের বাইরে এ বাহিনীর প্রথম মিশন। আইসল্যান্ডের সামরিক বাহিনী না থাকার পরেও দেশটি ন্যাটোর সদস্য। ন্যাটোভুক্ত মুসলিম দেশ ২টি: আলবেনিয়া ও তুরস্ক।

ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো:

প্রতিষ্ঠাতা দেশ (১২টি দেশ) – বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, ইটালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, পর্তুগাল, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র।

অন্যান্য সদস্য দেশ – গ্রীস, তুরস্ক, জার্মানি, স্পেন, চেক রিপাবলিক, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া, আলবেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, মন্টিনিগ্রো ও উত্তর মেসোডেনিয়া (সর্বশেষ সদস্য-২০২০)।

Warsaw Pact

ন্যাটো জোটের বিপরীতে পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের ৮টি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নিয়ে ১৯৫৫ সালে গঠিত সম্মিলিত প্রতিরক্ষা চুক্তি হল ওয়ারশ চুক্তি। এর আনুষ্ঠানিক নাম হল Treaty of Friendship, Cooperation and Mutual Assistance.

  • প্রতিষ্ঠা: ১৯৫৫
  • সদস্য: ৮টি দেশ – বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, পূর্ব জার্মানি, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন, আলবেনিয়া
  • সদর দপ্তর: মস্কো (রাশিয়া) ও ওয়ারশ (পোল্যান্ড)
  • বিলুপ্ত: ১৯৯১

স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন ঘটনা

কোরিয়া যুদ্ধ

১৯৪৫ সালে Trusteeship চুক্তির মাধ্যমে কোরিয়া উপদ্বীপ উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ায় বিভক্ত হয়। দক্ষিণ কোরিয়াকে যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়াকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে দেওয়া হয়। ১৯৪৮ সালে উভয় দেশকে স্বাধীনতা প্রদান করা হয়। স্বাধীনতার পর দুই কোরিয়ার মধ্যে পীত সাগর নিয়ে বিরোধ শুরু হয়। ১৯৫০ সালে দুই কোরিয়াকে একত্রিত করার উদ্দেশ্যে উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়াকে আক্রমণ করে। যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়াকে এবং চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উত্তর কোরিয়াকে সহযোগীতা করে। ১৯৫৩ সালে জাতিসংঘের ‘শান্তির জন্য ঐক্য’ প্রস্তাবের ভিত্তিতে কোরিয়া যুদ্ধের অবসান হয়।

  • যুদ্ধ: ১৯৫০-১৯৫৩
  • দুই কোরিয়ার সীমানা: ৩৮ ডিগ্রী অক্ষরেখা
  • পীত সাগরের সীমানা: নর্দান লিমিট লাইন
  • যুদ্ধ সমাপ্ত হয়: জাতিসংঘের ‘শান্তির জন্য ঐক্য’ প্রস্তাবের ভিত্তিতে।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ

সময়কাল: ১৯৫৫ – ১৯৭৫;

দ্বিতীয় ইন্দোচীন যুদ্ধ নামেও পরিচিত। সরকারিভাবে এটি ছিল উত্তর ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যেকার লড়াই। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন এবং অন্যান্য কমিউনিস্ট মিত্রদেশ উত্তর ভিয়েতনামকে সমর্থন করেছিল; অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য কমিউনিস্ট-বিরোধী মিত্রদেশ দক্ষিণ ভিয়েতনামকে সমর্থন করেছিল। আমেরিকা সরাসরি দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে যুদ্ধ শুরু করে ১৯৬৫ সালে।

ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স ভিয়েতনাম ছেড়ে যাওয়ার পর জেনেভা অ্যাকর্ড অনুসারে ভিয়েতনাম দু’ভাগে ভাগ করা হয়। উত্তর ভিয়েতনামের শাসনক্ষমতার দায়িত্ব নিলেন ভিয়েত মিন বিপ্লবীরা এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের দায়িত্ব দেয়া হলো আমেরিকাপন্থী সম্রাট বাও দাইকে। উত্তর ভিয়েতনামে সমাজতন্ত্র এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। দুই ভিয়েতনামের আদর্শিক দ্বন্দ্ব ও দুই ভিয়েতনামকে এক করার প্রয়াস থেকে যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৭৬ সালে দুই ভিয়েতনাম এক হওয়ার মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রীরা জয়ী হয় এবং মার্কিন জোটের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শেষ হয়। এ যুদ্ধের স্মরণে ভিয়েতনাম ওয়াল স্থাপিত হয় ফ্রান্সের প্যারিসে।

বার্লিন সংকট

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পটসডাম সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জার্মানিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের কর্তৃত্বাধীন চারটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়। ফলে রাশিয়া তার কর্তৃত্বাধীন অঞ্চলে পূর্ব জার্মানি এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা তাদের কর্তৃত্বাধীন অঞ্চলে পশ্চিম জার্মানি গঠন করলে জার্মানি দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। বার্লিন পূর্ব জার্মানির অধীনে ছিল। কিন্তু বার্লিন শহরকেও চারভাগে ভাগ করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র জোটকে বিপাকে ফেলার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন পশ্চিমা নিয়ন্ত্রাণাধীন বার্লিনে পশ্চিমাদের প্রবেশের রেল, সড়ক এবং খালের চলাচল পথ বন্ধ করে দেয়। এতে ঐ অঞ্চলে খাদ্য সংকট দেখা দিলে বার্লিন সংকটের সৃষ্টি হয়।

সোভিয়েত প্রভাবাধীন পূর্ব জার্মানি ১৯৬১ সালে ১৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বার্লিন প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। প্রাচীরটি প্রায় ২৮ বছর আক্ষরিক ও মতাদর্শগতভাবে বার্লিন শহরকে বিভক্ত করে রেখেছিল। ১৯৮৯ সালে প্রাচীরটি ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং ১৯৯০ সালে দুই জার্মানি একত্রিত হয়।

দাঁতাত

দাঁতাত ফরাসি শব্দ যার অর্থ উত্তেজনা প্রশমন। এটি সুসম্পর্ক পুনঃসংস্থান নয়, বরং শত্রুতার অবসান যা সুসম্পর্কের ভিত্তি ও পরিবেশ রচনা করতে সাহায্য করবে। স্নায়ুযুদ্ধকালে উত্তেজনা প্রশমনে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চুক্তি হয় যা দাঁতাত নামে পরিচিত। ১৯৬২ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত এই দাঁততের সময়কাল ধরা হয়।

কিউবা সংকট

যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা স্থাপন করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে কিউবায় ক্ষেপনাস্ত্র স্থাপন করতে উদ্যোগী হয়। উল্লেখ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিউবার দুরত্ব মাত্র ৯০ কিলোমিটার। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখালে পারমাণবিক যুদ্ধের শঙ্কা তৈরি হয়। ১৬ অক্টোবর ১৯৬২ থেকে ২৮ অক্টোবর ১৯৬২ পর্যন্ত এরূপ অবস্থা বিরাজমান থাকে। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত উভয় পক্ষই নিজেদের ক্ষেপণান্ত্র সরিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে সংকটের অবসান হয়।

আরও: আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন (উইকিপিডিয়া)

জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন

Non Align Movement (NAM)

জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন হল ১২০​​টি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের একটি ফোরাম যা আনুষ্ঠানিকভাবে কোন বড় শক্তি গোষ্ঠীর সাথে বা তাদের বিরুদ্ধে নয়। জাতিসংঘের পরে, এটি বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর বৃহত্তম সংস্থা। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধের সময় বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সোভিয়েত বা যুক্তরাষ্ট্র ব্লকে যোগদান প্রবণতা থেকে দূরে থাকতে এ জোটের সৃষ্টি। এ জোটের উদ্যোক্তা ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের, ইন্দোনেশিয়ার প্রসিডেন্ট সুকর্ণ, যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটো ও ঘানার প্রেসিডেন্ট নক্রুমা। ১৯৫৫ সালের ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত ‘বান্দুং সম্মেলন’ থেকে এ আন্দোলনের ধারণা আসে। ১৯৬১ সালে বেলগ্রেডে জোটের প্রথম সম্মেলনে NAM প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। সংস্থাটির সদর দপ্তর ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায়।

স্নায়ুযুদ্ধের অবসান

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে ১৯৯১ সালে স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি হয়।

এক নজরে –

ঘটনাসময়তথ্য
স্নায়ুযুদ্ধ১৯৪৫-১৯৯১সোভিয়েত ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব
ট্রুম্যান নীতি১৯৪৭স্নায়ুযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি
মলোটভ পরিকল্পনা১৯৪৭ট্রুম্যান নীতির বিপরীতে সোভিয়েত পরিকল্পনা
ডানকার্ক চুক্তি১৯৪৭দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সম্ভাব্য জার্মান আক্রমণের বিরুদ্ধে জোট
COMINFORM১৯৪৭ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর জোট।
মার্শাল পরিকল্পনা১৯৪৮ট্রুম্যান নীতি বাস্তবায়ন পরিকল্পনা
ব্রাসেলস চুক্তি১৯৪৮ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা এবং যৌথ আত্মরক্ষার চুক্তি। এটি মূলত ডানকার্ক চুক্তিরই সম্প্রসারিত রূপ।
COMECON১৯৪৯সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর অর্থনৈতিক সংগঠন।
NATO১৯৪৯যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সামরিক জোট।
কোরিয়া যুদ্ধ১৯৫০-১৯৫৩
European Coal and Steel Community১৯৫১কয়লা ও ইস্পাত শিল্প নিয়ন্ত্রণে গঠিত ইউরোপিয় সংস্থা।
Warsaw Pact১৯৫৫সোভিয়েত ও তার মিত্রদের সামরিক জোট।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ১৯৫৫-১৯৭৫উত্তর ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যেকার যুদ্ধ।
EEC১৯৫৮ইউরোপের আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংগঠন
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন১৯৬১
বার্লিন সংকট১৯৬১-১৯৮৯১৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বার্লিন প্রাচীর নির্মাণ।
কিউবা সংকট১৯৬২সোভিয়েত ইউনিয়নের কিউবায় ক্ষেপনাস্ত্র স্থাপন।
দাঁতাত১৯৬২-১৯৭৯উত্তেজনা প্রশমনে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চুক্তি
গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রৈকা১৯৮৭সোভিয়েত খোলানীতি।
47
Created on

স্নায়ুযুদ্ধ

বিগত সালের প্রশ্ন

1 / 17

সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ সমাজতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট ছিলেন-

2 / 17

দাঁততের সময়কাল -

3 / 17

বার্লিন প্রাচীরের সময়কাল-

4 / 17

ন্যাটোর বিপরীত জোট কোনটি?

5 / 17

ট্রুম্যান নীতিতে কোন দুটি দেশ মার্কিন আর্থিক সাহায্য লাভ করে?

6 / 17

'ডোমিনো তত্ত্বটি' কোন অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য ছিল?

7 / 17

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব-পশ্চিম দ্বন্দের ফলে সৃষ্ট পূর্বের অর্থনৈতিক জোটটির নাম ছিল -

8 / 17

'গ্লাসনস্ত নীতি' কোন দেশে চালু হয়েছিল?

9 / 17

ন্যাটোর একমাত্র মুসলিম সদস্য দেশ -

10 / 17

NATO-এর সদর দপ্তর কোথায়?

11 / 17

NATO stands for-

12 / 17

ন্যাটো সামরিক জোট কত সালে আত্মপ্রকাশ করে?

13 / 17

কে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সাথে যুক্ত নয়?

14 / 17

জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সদর দপ্তর কোথায়?

15 / 17

জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রথম শীর্ষ সম্মেলন কোথায়, কবে অনুষ্ঠিত হয়?

16 / 17

'বান্দুং সম্মেলন' অনুষ্ঠিত হয়েছিল কবে?

17 / 17

কোন দেশ ন্যাটোর সদস্য নয়?

Your score is

The average score is 61%

0%

Leave a Reply