চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের আদিমতম ও প্রচীন যুগের একমাত্র নিদর্শন। বলা যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস শুরু হয়েছে চর্যাপদের কাল থেকেই। এর মূল নাম চর্যাচর্যবিনিশ্চিত যার অর্থ হল ‘কোনটি আচরণীয়, আর কোনটি আচরণীয় নয়’। ‘চর্যা’ শব্দের অর্থ আচরণ।
চর্যাপদ কেন সাহিত্যকর্ম?
চর্যাপদ মূলত ধর্ম চর্চার জন্য রচিত হয়েছিল। এটি ছিল সহজিয়া সিদ্ধাচার্যদের সাধন সঙ্গীত যাতে বৌদ্ধধর্মের তত্ত্বকথা বিধৃত হয়েছে। চর্যাপদ বৌদ্ধ তত্ত্ববাদের বাহন, গৌণত কবিতা বা গান। চর্যাকারেরা দার্শনিক পরিভাষা ও তন্ত্রের বিশেষ শব্দের সাহায্যে তত্ত্বদর্শনকে প্রকাশ করতে গিয়ে নানা চিত্রকল্প, উপমা ও রূপকের প্রয়োগ করেছেন। সাহিত্যিক এসব উপাদান ব্যবহারের ফলে চর্যাপদ ক্রমেই সাহিত্যের পরিসীমায় এসেছে।
কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল / চঞ্চল চীএ পৈঠা কাল
চর্যাপদের প্রথম পদ (লুইপা)
উল্লেখ্য চর্যাপদের প্রথম পদের অর্থ “দেহ তরু বা গাছের মত, এর পাঁচটি ডাল / চঞ্চল চিত্তে বা মনে তাতে (দেহে) কাল (সময়) প্রবেশ করে”।
আবিষ্কার
চর্যাপদের আনুমানিক বয়স প্রায় ১০০০ বছর। ১৯০৭ সালে ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগার থেকে তালপাতায় লেখা চর্যাপদ আবিষ্কার করেন। মূলত ১৮৮২ সালে প্রকাশিত Sanskrit Buddhist Literature in Nepal গ্রন্থে তৎকালীন নেপালের রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র সর্বপ্রথম নেপালের বৌদ্ধতান্ত্রিক সাহিত্যের কথা প্রকাশ করেন। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের বই দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী “চর্যাচর্যবিনিশ্চয়” নামক কিছু পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেন। পরবর্তীতে ১৯১৬ সালে ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে “হাজার বছরের পুরান বাঙালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা” নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এটিই পরে চর্যাপদ নামে পরিচিতি পায়।
তালপাতায় লিখিত মূল পুথিটি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল থেকে নিয়ে আসেননি। তিনি এনেছিলেন একটি প্রতিলিপি। প্রতিলিপিটি সংরক্ষিত আছে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে, যার ক্যাটালগ নম্বর ৮০৬৩। ‘আদি ও আসল’ পুথির অবস্থান এখন অজ্ঞাত। গত শতকের ছয় দশকের মাঝামাঝি নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগার বন্ধ হয়ে জাদুঘরে পরিণত হয়। এই বইগুলো নেপালের জাতীয় আর্কাইভসে নেয়া হলেও চর্যাপদের মূল এবং সম্পূর্ণ খণ্ডটি হয়তো আর অক্ষত নেই। হয়তো হারিয়ে গেছে।
ভাষা বিতর্ক
গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক সম্পদ ‘চর্যাপদ’ নিয়ে বিতর্ক ও দ্বিমতের শেষ নেই। গ্রন্থটির সঙ্গে ভারতবর্ষে বিদ্যমান ভাষাসমূহের অধিকাংশ প্রধান আধুনিক ভাষার ঐতিহাসিক বিবর্তন যুক্ত থাকায় প্রায় সব ভাষাভাষী পণ্ডিতগণ জাতীয় গৌরবের ভিত্তি থেকে চর্যাপদকে নিজ ভাষার আদি নিদর্শন হিসেবে দাবি করেছেন। আবিষ্কারক হিসেবে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি করেন চর্যাপদের ভাষা বাংলা, রাহুল সাংকৃত্যায়ন দাবি করেন এর ভাষা হিন্দি; একইভাবে বিভিন্ন ভাষার গবেষকবৃন্দ তাঁদের ভাষার সঙ্গে চর্যাপদের সম্পর্ক অন্বেষণ করেছেন এবং চর্যাপদকে নিজেদের মাতৃভাষার আদি নমুনা হিসেবে দাবি করেছেন।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর সম্পাদিত হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা বৌদ্ধ গান ও দোহা গ্রন্থের ভূমিকায় ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’, ‘সরহপাদ ও কৃষ্ণাচার্যের দোহা’ এবং ‘ডাকার্ণব’-কে সম্পূর্ণ প্রাচীন বাংলার নিদর্শন বলে দাবি করেছেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আবিষ্কারকর্তা ও সম্পাদক বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভও তাঁর দাবিকে সমর্থন করেছেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে বিজয়চন্দ্র মজুমদার চর্যাগীতিকে বাংলার প্রাচীন নমুনা হিসেবে অস্বীকার করেছিলেন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় চর্যাগান ও দোহাগুলির ধ্বনিতত্ত্ব, ব্যাকরণ ও ছন্দ বিশ্লেষণ করে তাঁর The Origin and Development of the Bengali Language গ্রন্থে এগুলিকে প্রাচীন বাংলার নিদর্শন হিসাবে গ্রহণ করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যাপদের ধর্মতত্ব বিষয়ক গবেষণা করেন এবং ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে তার প্যারিস থেকে প্রকাশিত Les Chants Mystique de Saraha et de Kanha গ্রন্থে সুনীতিকুমারের মতামতকে গ্রহণ করেন। রাহুল সাংকৃত্যায়ন বা অন্যান্য ভাষার বিদ্বজ্জনেরা, যাঁরা চর্যাকে নিজ নিজ ভাষার প্রাচীন নিদর্শন বলে দাবি করেছিলেন, তাঁরা এরকম সুস্পষ্ট ও সুসংহত বৈজ্ঞানিক প্রমাণের দ্বারা নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন নি।
চর্যাপদকে কেন সন্ধ্যাভাষা বলা হয়?
মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত চর্যাপদের ভাষাকে এর অস্পষ্টতার জন্য সন্ধ্যা/সান্ধ্য ভাষা বলা হয়। তিব্বতি ভাষায় ‘সন্ধ্যাভাষা’র অর্থ ‘প্রহেলিকাচ্ছলে উক্ত দুরুহ তত্ত্বের ব্যাখ্যা’। চর্যার পদগুলো লৌকিক অর্থের বদলে সংকেতে আবৃত হওয়ায় তা বোঝা সর্বসাধারণের জন্য বেশ কষ্টকর। যেমন: চর্যাপদে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস অর্থে ‘চন্দ্র’, চিত্ত অর্থে ‘হরিণ’, জ্ঞানসমুদ্র অর্থে ‘হরিণী’, মহাসুখকায় অর্থে ‘নৌকা’ প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়েছে। এক্ষেত্রে চর্যাপদের আবিষ্কারক ড. শাস্ত্রীর নিম্নোক্ত উক্তিটি উল্লেখযোগ্য-
সহজিয়া ধর্মের সকল বই-ই সন্ধ্যা ভাষায় লেখা। সন্ধ্যা ভাষার মানে আলো-আঁধারি ভাষা, কতক আলো, কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায়, খানিকটা বুঝা যায় না। অর্থাৎ এই সকল উঁচু অঙ্গের ধর্মকথার ভিতরে একটা অন্য ভাবের কথাও আছে। সেটা খুলিয়া ব্যাখ্যা করিবার নয়। যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সে কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই।
ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
কবি ও পদ
চর্যার কবিরা ছিলেন পূর্ব ভারত ও নেপাল রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসী। তারা পূর্ববঙ্গ, উত্তরবঙ্গ, রাঢ় প্রভৃতি জায়গার অধিবাসী ছিলেন। তাদের গোত্রেও ভিন্নতা ছিল; ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, ক্ষত্রিয়, বণিক এমনকি অন্ত্যজ শ্রেণী থেকেও চর্যার কবিরা এসেছিলেন। কেউ কেউ রাজবংশজাতও ছিলেন। তারা পূর্বাশ্রমের পিতৃপ্রদত্ত নাম ত্যাগ করেছিলেন বলে নাম দেখে তাদের জাতি স্থির করা যায় না। তবে চর্যাপদের গানের মাঝে ও শেষের ভনিতা থেকে পদকর্তাদের পরিচয় পাওয়া যায়। পদকর্তাদের নামের শেষে পদ রচনার জন্য গৌরব সূচক ‘পা’ যোগ করা হয়েছে। পদকর্তারা প্রায় সবাই বৌদ্ধ চৌরাশি সিদ্ধার অন্তর্গত।
চর্যাপদে মোট পদ রয়েছে মতভেদে ৫০/৫১টি, যার মধ্যে পাওয়া গেছে ৪৬টি। ২৩ নং পদের খণ্ডাংশ (প্রথম ৬ লাইন) পাওয়া গেলেও ১১ (মোট পদ ৫১টি ধরলে), ২৪, ২৫ ও ৪৮ নং পদগুলো পাওয়া যায় নি।
কবি / পদকর্তা | পদ সংখ্যা | তথ্য |
---|---|---|
কাহ্নপা | ১৩ | সবচেয়ে বেশি পদ রচয়িতা। তার রচিত ১১ ও ২৪ নং পদটি পাওয়া যায় নি। |
ভুসুকুপা | ৮ | নিজেকে বাঙালী হিসেবে দাবি করেছেন। ২৩ নং পদটি তার রচনা। এর খণ্ডাংশ পাওয়া গেছে। |
সরহপা | ৪ | |
কুক্কুরীপা | ৩ | নারী পদকর্তা হিসেবে অনুমান করা হয়। তার রচিত ৪৮ নং পদটি পাওয়া যায় নি। |
লুইপা, শবরপা ও শান্তিপা | প্রত্যেকে ২টি করে | লুই পাকে চর্যাপদের আদি কবি বলা হয়। তার রচিত পদ নং ১ ও ২৯। তিনি বাঙালি ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। |
অন্যান্য কবি | প্রত্যেকে ১টি করে | তন্ত্রীপা রচিত ২৫ নং পদ পাওয়া যায় নি। |
লাড়ীডোম্বীপা | ১টি পদের উল্লেখ আছে, তবে পদটি নেই |
উল্লেখ্য আবিষ্কৃত চর্যাপদে ২৪ জন (মতান্তরে ২৩ জন) পদকর্তার নাম পাওয়া যায়।
প্রবাদ বাক্য ও অর্থ
পদ | পদ নং ও পদকর্তা | অর্থ |
---|---|---|
আপণা মাংসে হরিণা বৈরী | ৬নং পদ ভূসুকপা | হরিণের মাংসই তার নিজের জন্য শত্রু |
হাতের কঙ্কণমা লোউ দাপণ | ৩২নং পদ সরহপা | হাতের কাঁকন দেখার জন্য আয়নার প্রয়োজন হয় না। |
দুহিল দুধু কি বেন্টে সামায় | ৩৩নং পদ ঢেণ্ডণপা | দোহন করা দুধ কি বাটে প্রবেশ করা যায়? |
হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী | ৩৩নং পদ ঢেণ্ডণপা | হাঁড়িতে ভাত নেই, অথচ প্রতিদিন প্রেমিকরা এসে ভীড় করে |
বর সুণ গোহালী কি মো দুঠ্য বলন্দেঁ | ৩৯নং পদ সরহপা | দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো |
অণ চাহন্তে আণ বিণঠা | ৪৪ নং পদ কঙ্কণপা | অন্য চাহিতে, অন্য বিনষ্ট |
চর্যাপদ বিষয়ক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ
গ্রন্থ | লেখক |
---|---|
Buddhist Mystic Songs (১৯২৭) | ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ |
নতুন চর্যাপদ (২০১৭) | সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ |
Mystic Poetry of Bangladesh (২০১৭) | হাসনা জসীমউদ্দীন মওদুদ |
আরও তথ্য
- চর্যাপদের অন্য নাম – চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, আশ্চর্যচর্যাচয় (মুনিদত্তের মতানুসারে), চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়, চর্যাগীতিকোষ, চর্যাগীতিকোষবৃত্তি।
- চর্যাপদ রচিত হয় পাল আমলে।
- চর্যাপদ পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে রচিত। তবে আধুনিক ছন্দের বিচারে চর্যাপদ মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত।
- চর্যাপদের টীকাকার মুনিদত্ত। তবে তিনি ১১ নং পদের ব্যাখ্যা দেননি।
- চর্যাপদের ভাষা বাংলা প্রমাণ করেন – ড.সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।
- চর্যাপদের প্রথম পদ লেখক লুইপাকে বাংলা সাহিত্যের আদিকবি বলা হয়। তিনি প্রথম বাঙালি পদকর্তা।
- আধুনিক পদকর্তা – সরহপা অথবা ভুসুকপা। ৪৯ নং পদে ভুসুকপা নিজেকে বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিয়েছে।
- শবরপাকে চর্যাপদের শ্রেষ্ঠ কবি বলা হয়। তিনি লুইপার গুরু। গবেষকগণ তাকে বাঙ্গালী কবি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। চর্যার কবিদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন বলে মনে করা হয় শবরপাকে (৬৮০ থেকে ৭৬০ খ্রিস্টাব্দ)।
- চর্যাপদের প্রথম বাঙালি কবি – মীননাথ/মাৎসেন্দ্রনাথ। তাঁর কোন পূর্ণাঙ্গ পদ পাওয়া যায়নি।
- চর্যাপদে ৫টি ভাষার মিশ্রণ রয়েছে – বাংলা, হিন্দি, মৈথিলি, অসমিয়া, উড়িয়া।
- চর্যার এক একটি পদ সাধারণত ১০টি লাইন সহযোগে গঠিত। তবে ২১নং পদে লাইনসংখ্যা ৮টি এবং ৪৩ নং পদে লাইন সংখ্যা ১২টি।
- চর্যাপদের ইংরেজি অনুবাদ ‘মিস্টিক পোয়েট্রি অব বাংলাদেশ’। ২০১৭ সালে হাসনা জসীমউদ্দীন মওদুদ (কবি জসীমউদ্দীনের কন্যা) তালপাতার মূল পাণ্ডুলিপি থেকে চর্যার ইংরেজি অনুবাদটি করেন।
সূত্রঃ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রচ্ছেদ ও অন্যান্য
বিগত সালের লিখিত প্রশ্নগুলো একনজরে
- চর্যাপদকে কেন সন্ধ্যাভাষা বলা হয়? (৪০ তম বিসিএস)
- বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন চর্যাপদের ভাষাকে কেন ‘সন্ধ্যা ভাষা’ বলা হয়? (৩৮ তম বিসিএস)
- চর্যাপদে নিম্নবর্গীয় মানুষের যে পরিচয় পাওয়া যায় তার বিবরণ দিন? (৩৬ তম বিসিএস)
- চর্যাপদের ভাষা নিয়ে বিদ্যমান বিতর্ক সম্পর্কে আপনার ধারণা লিখুন। (৩৫ তম বিসিএস)
আরও দেখুন: যুগবিভাগ ও প্রাচীনযুগ (মডেল টেস্ট)